|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
মেলবন্ধন ঘটে ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার |
সিমায় চলছে ‘আর্ট ইন লাইফ’ শীর্ষক প্রদর্শনী। দেখে এসে লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যেরও রূপান্তর ঘটে। বিশেষত আমাদের মতো দেশে যেখানে বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতি- আদিম, লৌকিক, আধুনিক- জীবনযাপন ও জীবিকার বৈচিত্রময় নানা দিক নিবিড় বুননে পাশাপাশি অবস্থান করছে, সেখানে উচ্চস্তরের প্রযুক্তি-অধ্যুষিত ভোগবাদী জীবনধারার দ্রুত বিস্তার ও ঐতিহ্যের এই সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনাকে খুব সহজে নির্মূল করতে পারে না। বরং আধুনিকতাকেই তা নানা ভাবে প্রভাবিত করে তার প্রকাশভঙ্গিতে স্বতন্ত্র এক প্রাণের সঞ্চার ঘটায়। আবার এটা করতে গিয়ে পরম্পরাগত প্রকাশভঙ্গিও খুব ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে এ ভাবেই একটা আদানপ্রদানের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এটা যে শুধু আজকের যুগেই ঘটছে তা নয়। চিরদিনই এটা খুব ধীর গতিতে ঘটে থাকে। আজকের যুগে সামাজিক রূপান্তর যখন খুব দ্রুত ঘটছে, তখন আদিম বা লৌকিক সেই দ্রুততার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। তার অস্তিত্ব বা প্রাসঙ্গিকতা ছায়াচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। তখন আধুনিক সমাজ সংস্কৃতির ভিতরই এক ধরনের দায়বোধ জেগে ওঠে যাতে সে ঐতিহ্য থেকে রসদ সংগ্রহ করে নিজেকেই প্রাণবন্ত করে তুলতে চায়। আজকের দিনে এই দ্বৈততার প্রক্রিয়াটা খুব সফল ভাবে অনুসৃত হচ্ছে।
এটা বোঝা যায় সিমা গ্যালারির ‘আর্ট ইন লাইফ’ শীর্ষক প্রদর্শনীটি দেখলে। প্রতি বছরের শারদীয় উৎসবের প্রাক্কালে ‘সিমা’ সারা ভারতের পরম্পরাগত শিল্প ও শিল্প অন্বিত সামগ্রীর বিপুল সম্ভার এনে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে। তাতে রয়েছে অলঙ্করণ শিল্পের নানা দৃষ্টান্ত। আদিবাসী ও লৌকিক শিল্পীদের করা ব্রোঞ্জ ও কাঠের মূর্তি— এই পর্যায়ে ডোকরা ঢালাই পদ্ধতির মূর্তিগুলি খুব সুন্দর। রয়েছে মুখোশের বিচিত্র সম্ভার, নানা আঙ্গিকের পুতুল। দৈনন্দিন ব্যবহারোপযোগী জিনিসের মধ্যে রয়েছে শাড়ি, দোপাট্টা, বিছানার চাদর ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিস, ছেলেদের পোশাক, টি-শার্ট বা পাঞ্জাবি, নানা ধরনের পর্দা, ব্যাগ ইত্যাদি। এ ছাড়াও থাকে ছবির প্রিন্ট, গ্রিটিংস কার্ড, লেখার প্যাড ইত্যাদি বিচিত্র সামগ্রী যা দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত। এ সব কিছুই থাকে একটিই কারণে । যাতে তার মধ্য দিয়ে সৌন্দর্য বা নান্দনিকতার বিশেষ মাত্রাকে জীবনের ভিতর পরিব্যাপ্ত করা যায়। |
|
সিমায় আয়োজিত প্রদর্শনীর একটি ছবি |
এখানেই আসে সেই দ্বৈততার প্রসঙ্গটি। কী ভাবে লৌকিক প্রবেশ করছে আধুনিক জীবনযাপনের ভিতরে। লৌকিক শিল্পীরা পটচিত্র করেন। কাগজের উপর আঁকেন তাঁদের নিজস্ব আঙ্গিকের ছবি। শহরের অনেক মানুষেরই দৈনন্দিনতার ভিতর তা প্রবেশ করতে পারে না। এখন তাঁদের নিয়ে পুরুষ বা নারীর পোশাক অলংকৃত করানো হচ্ছে। তাঁরা অ্যাক্রিলিক রঙে আঁকছেন শাড়ি বা দোপাট্টার উপর, টি-শার্ট বা পাঞ্জাবির উপর। এই উপস্থাপনায় তাঁদের প্রথাগত যে রূপভঙ্গি তার কিছু পরিবর্তনও ঘটছে। স্বর্ণ চিত্রকরের কাজের সঙ্গে ‘সিমা’র বিভিন্ন প্রদর্শনীর অনেক দর্শকই পরিচিত। এখানে সেই স্বর্ণ চিত্রকর যখন তাঁর আঁকা ছবি দিয়ে পোশাক অলঙ্কৃত করেছেন, তখন তাঁর ছবিতেও কিছু রূপান্তর ঘটেছে। সমীর আইচ, শ্যামল রায় বা চন্দ্রিমা রায়ের মতো আরও অনেক শিল্পীর কাজই এ দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ।
এ বারের প্রদর্শনীতে একটি বিশেষ উপকরণ হিসেবে এসেছে ‘অহিংসা শাড়ি’। হিংসা বা সন্ত্রাস যখন সমাজের সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত হচ্ছে, তখন জীবনযাপনের গভীরে তার বিরুদ্ধে কী ভাবে প্রতিক্রিয়া জেগে ওঠে, তারই একটি দৃষ্টান্ত এই ‘অহিংসা শাড়ি’ বা ‘শান্তির সিল্ক’। এই রেশমি বস্ত্র তৈরি করা হয় এমন এক পদ্ধতিতে যাতে যে গুটিপোকার লালা থেকে তৈরি হয় এর সুতো, সুতো তৈরির প্রক্রিয়ায় সেই পোকা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না।
প্রদর্শনীতে দৃষ্টি আকর্ষণ করে অভিনব কিছু মুখোশ। তামিলনাড়ু অঞ্চলের এক ঝাঁক মুখোশের মধ্যে রূপের যে বৈচিত্র, তাতেও আদিম বা লৌকিকের উপর আধুনিকতার প্রভাবের কিছু মাত্রা সক্রিয় থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নব্য-প্রস্তর যুগ থেকে চলে আসছে মুখোশের সৃজন প্রক্রিয়া। আজকের মুখোশের ভিতরও সেই পুঞ্জীভূত অতীত কী ভাবে সংহত হয়ে থাকে, দেখে মুগ্ধ হতে হয়। |
|
|
|
|
|