|
|
|
|
|
|
|
সেমিনার |
চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
|
গীতা মাহাতোর কথা |
উরিব্বাস! মাণ্ডবী নদীটা এমন! বিদেশে যাইনি তো কখনও, কিন্তু কেমন যেন ভেনিস-ভেনিস মনে হচ্ছে, ইংরেজি ছবিগুলোতে দেখায় যেমন! কত লঞ্চ, ফেরি মানুষ পারাপার করছে। এর কাছে আমাদের কাঁসাই! থাক বাবা, এত আদেখলেপনা করব না, সঙ্গে আরও মেয়েরা রয়েছে তো! ভাববে, পুরুলিয়া থেকে এসেছে, আদিবাসী-টাসি হবে... তা সত্যি, সেই বিবির বাঁধে জন্ম আর সেমিনার করতে এলাম গোয়ায়! স্বপ্ন মনে হচ্ছিল, ডাকে চিঠিটা এল যখন। সঙ্গে মেয়েলোকগুলোকে দেখি, সব ক’টাই আমার চেয়ে ঢের ধনী ঘরের বলে মনে হয়। ওই মেয়েটা কেমন দগদগে করে সিঁদুর দিয়েছে সিঁথিতে, এ দিকে আবার হাঁটু অবধি জিন্স! আমাদের এয়ারপোর্টে নিতে এল যে লোকটা, তিন জন কো-অর্ডিনেটরের এক জন, রঘুবীর রাও, ওর দিকে আড়েঠারে দেখছে দেখো! আলোচনায় সাপ-ব্যাঙ যা-ই বলুক না কেন, ঢংঢাং দেখিয়েই তো বিশ্বজয় করে নেয়। সব জানা আছে আমার। সব ক’টা মেয়েকে দেখেই ছেনাল মনে হচ্ছে। কী করে যে তিনটে দিন কাটাব এদের সঙ্গে।
এয়ারপোর্টে তো গরু, শুয়োর কী সবের স্যান্ডউইচ দিল কে জানে! গপগপ করে খেল, সব ক’টা মিলে। আমি বাপু শশা খেয়েই কাটিয়ে দিলাম, সঙ্গে মুড়ির কৌটোও এনেছি। আর এদের দেখো, খেয়েদেয়ে হাতমুখ ধুলো না পর্যন্ত, দিব্যি পাতলা কাগজে মুছে নিল। এ সব সোসাইটিই এমন নোংরা, ভেতরে, বাইরে, সব দিকে। আমার মতো চাষির ঘরের মেয়ে তো আর নয়! |
|
সন্ধ্যা দত্তর কথা |
দেখেছ কাণ্ড! ঈশ্বরী এখানে এসেও দিব্যি একটা পুরুষমানুষ ফিট করে নিয়েছে। দিল্লির মেয়ে হলেও থাকে তো কলকাতায়। হিন্দি, ইংরেজিতে লেখে। হুঁ, কলকাতায় ওর নিন্দেয় কান পাতা দায়। ভোর থেকে উঠেই মদের বোতলের ছিপি খুলে বসে থাকে। বার দুয়েক বিয়েও তো করেছে শুনেছি। শেষেরটা এখনও টিকে আছে কি না, কে জানে? ইন্ডিয়ান লিটারারি ফোরাম থেকে স্পিড পোস্টে চিঠিটা এল যখন, ‘আওয়ার ভয়েসেস’ প্রোগ্রামটায় যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ নিয়ে, তখন তো জানতামই না কে কে আসছে, তবে হ্যাঁ, শুধু যে মেয়েরাই, সেটা লেখা ছিল বটে! বলেছিল জানাতে, যদি অসুবিধে থাকে। আমার আর অসুবিধে কোথায়! ঝাড়া হাত-পা। বর জাহাজে, ছেলে দুন স্কুল। ঈশ্বরীর মতো নষ্টামি করে বেড়াতে চাইলে সুযোগের অভাব! ওর লেখায় আছেটাই বা কী? শুধু সেক্স আর সেক্স। সে-দিন আমার বাড়ির সাহিত্যসভায় নীলেন্দু, মৈনাক, অমৃত সকলেই এসেছিল, না এসে যাবে কোথায় বিরিয়ানি, কাবাব, ফরেন লিকার, সব রকম ব্যবস্থাই তো রাখা থাকে ওদের জন্য। তবে মিথ্যে বলব না, এদের পত্রিকার থেকে এ বারের ‘রাসসুন্দরী দেবী’ অ্যাওয়ার্ড তো আমাকেই দেবে শুনলাম! তা, পেটপুরে খেয়েদেয়ে সে দিন সব বেরোচ্ছে যখন, মৈনাক বলল, সন্ধ্যাদি, ঈশ্বরীর নতুন যে কবিতাটা ‘টাইমস’-এ বেরিয়েছে, দেখেছ? কেমন আনক্যানি, না? তা-ই বটে! সেমিনারে নাম কা ওয়াস্তে কতকগুলো বানানো কথা উগড়ে দিচ্ছে, আর বাকি সময়টা ওই যে কো-অর্ডিনেটর, কে আর কৃষ্ণমূর্তি, তার হাত ধরে সি-বিচ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, বিয়ার-টিয়ারও খাচ্ছে নিশ্চয়ই! যদি এরা অ্যালাও করে, শেষ দিন আমার পয়সায় একটা বিচ-পার্টি দেব ভাবছি, চোখ টেরা হয়ে যাবে সকলের।
|
ঈশ্বরী নায়েকের কথা |
থ্যাঙ্ক গড! গীতার রুম শেয়ার করতে হচ্ছে না আমাকে। এক দিনেই প্রাণ অস্থির হয়ে গেছিল। ওই যে বাঙালি কো-অর্ডিনেটর, দীপন রায়, বেশ নরম ধরনের লোক, ওকে বলেকয়ে ঘর পাল্টে মিসেস রোহিণী মহাজনের সঙ্গে থাকব আজ আর কাল। ওফ্, রাতের শেষ সিগারেটটায় টান না দিলে কি চলে? তাও তো ঘরে নয়, ব্যালকনিতে গিয়ে খাচ্ছিলাম। সে মেয়ে ঠিক গন্ধে গন্ধে গুটিগুটি পায়ে এসে পাকড়েছে আমাকে! ‘যা-ই বলো ঈশ্বরী, ছেলেদের ঠোঁটেই সিগারেট মানায়। আমি তো ভাবতেই পারি না কোনও মহিলা...’ মাই ফুট! তুই কী ভাবতে পারিস না পারিস, তাই বুঝে আমাকে চলতে হবে নাকি? প্রেগন্যান্সির ইনিশিয়াল স্টেজে কাউকে ধাক্কা মেরে শ্বশুরবাড়ির লোকজন সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে দিচ্ছে, সেটা ভাবতে পারিস! যাক গে, কুল ডাউন, ঈশ্বরী, কুল ডাউন! আর এক জাঁহাবাজ মেয়ে, সন্ধ্যাটা। কী ভাবে যেন এসেই ধরেটরে একটা সিংগল রুম ম্যানেজ করে নিল। এখানেও পয়সা ছড়িয়েছে নির্ঘাত! কলকাতায় তো পয়সা দিয়ে সাহিত্যের বাজারটাই কিনে নিচ্ছে। কাল রাতে ওর ঘরের বাইরে পায়ের শব্দ শুনলাম যেন! এই জন্যই একার ঘর নেওয়া, তা হলে! কী যে সেমিনার হচ্ছে। যেমন ক্যাতকেতে, তেমনই অর্ডিনারি।
কাল রবীন্দ্রভবনে গীতার কবিতাগুলো, সিম্পলি হরিবল! কবিতায় দুঃখ বিক্রি করাই হল গিয়ে ওর কাজ। দুঃস্থ, পীড়িত কথাবার্তা। আর ইচ্ছে করে ম্যাটমেটে সব শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ও যে আমাদের চেয়ে আলাদা, মাটির কাছাকাছি থাকা কবি, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য!
|
মৃত্তিকা পাণিগ্রাহীর কথা |
এই সব মেয়েগুলো খুব মড টাইপ। ওদের মতো হতে ইচ্ছে করে। বাব্বাঃ, আমার হাজব্যান্ড যে গোয়ায় আসার পারমিশন দিল, এই না কত! শাশুড়ি তো প্রথমেই গোঁসা করে বসেছিল। ঈশ্বরী মেয়েটার খুব ডাঁট, আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। না দিক গে! আর সন্ধ্যা? নাকে, কানে যতগুলো ফুটো, সবেতেই শুধু হিরে আর হিরে। আমি ওড়িশার একটা ছোটখাটো গ্রামের মেয়ে, কেন যে এই কমপ্লেক্স এখনও মন থেকে যায় না! রোহিণী মহাজন কিন্তু বুদ্ধি ধরেন বেশ। নিজের ‘ভয়েস’ জানাতে গিয়ে, কাজকর্মের কথাটাও কায়দা করে বলে দিলেন। রাজস্থানে, মরুভূমির মধ্যে কী ভাবে ছোট ছোট সবুজ সব গ্রাম গজিয়ে উঠেছে, সেখানে ওঁর কী অ্যাক্টিভিটি, বিশদ ভাবে বললেন সে সব। সবাই শুনলও বটে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। স্রেফ প্রোপাগান্ডা! নিজের প্রচার! আমরা যেন সব কূপমণ্ডূক, আর উনি একাই নেমে এসেছেন স্বর্গ থেকে। কেমন হাত নেড়ে নেড়ে বলছিলেন। ‘সমুদ্রটা ফ্যাবুলাস! আমরা কিন্তু কেউ চেয়েও দেখছি না সে দিকে।’ কে বলল দেখছি না? তোমার মতো জোরে জোরে মাইকে ঘোষণা করছি না সেটা, এই আর কী! গলা উঁচু করে নিজের কথা নিজে বলতে পারলামই না তো কোনও দিন। লেখার কাগজে ছাড়া! তাও তো কত প্রসঙ্গ ঢেকেঢুকে রাখতে হয়। এখানে ভেবেছিলাম, একটু অন্য রকম আলোবাতাস পাব হয়তো। ওমা, কোথায় কী!
|
নীলিমা গোগুই-এর কথা |
পাহাড়, জঙ্গল, নদী আর সন্ত্রাসের দেশ আমার। সমুদ্র দেখে কেমন পাগল-পাগল লাগছে। অতিরিক্ত ভাবাবেগ প্রকাশ করে ফেলেছিলাম বোধ হয়, সবাই আমাকে দেখেই কেমন মুখ টিপে হেসে সরে যাচ্ছে। আসলে আমি তো ওদের মতো গ্ল্যামারাস আর দেখতে ভাল নই। ন্যাকামোও করতে পারি না। এখন মনে হচ্ছে, শাড়ি না এনে শুধু মেখলা-চাদর আনলেই কাজ দিত। চোখে পড়তাম বেশি। লাঞ্চ টাইমে দেখলাম তো, ওই যে বাঙালি ভদ্রলোক, দীপনবাবু, তিনি ঈশ্বরীকে, সন্ধ্যাকে, রোহিণীদিকে গোয়ান কারি খাওয়ানোর জন্য কত সাধাসাধি করছিলেন, আর আমার প্লেটটাও যে খালি, সে-দিকে কিন্তু খেয়ালই নেই! আমিও ঠিক করে নিয়েছি, তিন দিনের ব্যাপার, কারও সঙ্গে যেচে কথা বলব না। স্টেজে উঠে, নিজের পেপার পড়ে, নেমে এসে অটো নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে সমুদ্রের ধারে বসে থাকব।
|
বাসন্তী রামকৃষ্ণনের কথা |
আমরা নাকি পোয়েটেস! সারাক্ষণ স্বার্থপরের মতো চেঁচামেচি করে যাচ্ছি! এর ঘর থেকে ভিউ দেখা যায় না, অমুকের একটাও ছবি উঠল না, তমুককে কবিতা পড়তে বেশি সময় দেওয়া হয়নি, কাকে নাকি ইনটেনশনালি বাজে ঘর দেওয়া হয়েছে, কল থেকে গরম জল পড়ছে না। ইস্, বাড়িতে এদের জন্য গিজার, এসি মেশিন থইথই করছে একেবারে। নীলিমাকেই দেখো, কাল লাঞ্চ না খেয়ে, নাটক করে উঠে চলে গেল। খাবার পছন্দ না, ওকে ঠিকমত অ্যাটেন্ড করা হচ্ছে না। বাড়িতে তো বোধ হয় শুঁটকি মাছ খেয়ে থাকে। সকলের সব রকম ভয়েসই তো শুনছি, আমার মতো অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার, নামডাক, ধারেকাছেও আসে না কেউ। এই গ্রুপে আমি ছাড়া আর এক জনই আই এ এস আছে। ওই তো সন্ধ্যা, রবীন্দ্রভবনে এই গরমের মধ্যেও লাল টুকটুকে সাউথ ইন্ডিয়ান গায়ে জড়িয়ে আত্মজৈবনিক কাঁদুনি গেয়ে যাচ্ছে। মিসেস মহাজনও পারেন বটে। এখানে এসে ফান্ডিংয়ের ধান্দা করে বেড়াচ্ছে। আহ, আবার মাইগ্রেন শুরু হল। এত কিছু কি আর তিন দিন ধরে নেওয়া যায়? দেখি, মি. রাওকে পটিয়ে একটা ক্যাব জোগাড় করে সাউথ গোয়া ঘুরে আসা যায় কি না। নিজের পয়সায় যেতে গায়ে জ্বর আসে, এটাও লিটারারি ফোরামের আয়োজনে হয়ে যায় যদি, মন্দ কী!
|
রোহিণী মহাজনের কথা |
সবটাই সুন্দর। ফুলের মতো সুগন্ধী, না-সুগন্ধী, আমরা মেয়েরা সব জড়ো হয়েছি এখানে, নিজেদের গলার স্বর পৌঁছে দিতে। হয়তো বা নিজেদেরই কাছে। কিন্তু, কিন্তু ঈশ্বর, তোমার এই চমৎকার পৃথিবীতে মেয়েদের এত কষ্ট কেন?
|
কো-অর্ডিনেটরদের কথা (একযোগে) |
ওহ্, একসঙ্গে এত জন ভদ্রমহিলাকে হ্যান্ডেল করা চাট্টিখানি কথা। কালঘাম ছুটিয়ে ছেড়ে দিল একেবারে! (কে আর কৃষ্ণমূর্তি: সমুদ্রের ধারে টেনে নিয়ে গেল, বিয়ার খাওয়াল, গায়ে ঢলে পড়ছিল কেমন, কিন্তু আমাকে নখের ডগাটাও ছুঁতে দিল না। শুনি তো বগলে মাদুর নিয়ে সর্বত্র ঘোরে, তা আমাদের একটু-আধটু প্রসাদ বিতরণ করলে, ক্ষতি কী ছিল। এদেরকেই বলে সোসাইটি লেডি। দীপন রায়: আমি তো দরজায় খুটখুট শব্দ হতেই সটান দাঁড়িয়ে উঠেছি, আরে! শুধু পা কেন, পুরো শরীরটাই খাড়া হয়ে গেছে তখন। ওমা, চাইতে এল কিনা সিগারেট, ওর নাকি স্টক ফুরিয়ে গেছে। মেয়েদের একা একা নেশা করাটা ব্যান করে দেওয়া উচিত। খেতেই পারে, মদের গ্লাসে ঢুকুঢুকু চুমুক, সিগারেটে এক-আধটা পাফ, কিন্তু সে সব আমাদের সামনে। দেখেও চোখের সুখ। রঘুবীর রাও: আরে ইয়ার, এখানে যতই চাকর হয়ে থাকি না কেন, বাড়িতে তো আমরা সবাই এক এক জন সামন্তরাজা। কাল ফিরব, সোফায় গা এলিয়ে বউকে জুতো খুলে, ঠান্ডা জল এনে দিতে বলব। তার পর তো মস্তির জন্য সারাটা রাত পড়েই আছে।) আর দেখো, এরা কিছুতেই যেন খুশি হতে শেখেনি। সব সময় শুধু চাই! চাই! চাই! সাধে কি আর শেক্সপিয়ার বলেছিলেন...
|
শেষ কথা |
সব ফ্লাইট ক্যানসেল। লোকজনের উৎকণ্ঠিত ভিড় থাকলেও এয়ারপোর্টটা কেমন শ্মশান চত্বর মনে হচ্ছে। অথরিটি অবশ্য কাছেই একটা মাঝারি মাপের হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন সকলের। আজ রাতের জন্য।
সন্ধ্যা দত্ত ক্রিম ঘষছিল গালে। অন্যমনস্ক ভাবে বলল, আবার সেই খাঁ-খাঁ করা বাড়ি। আমাকে গিলে খেতে আসবে রোজ। অসিত আজকাল নানা অজুহাতে আসা পিছিয়ে দেয়। বন্দরে বন্দরে বউ রাখা আছে কি না, কে জানে? অট্টহাসি হাসতে গেল, শেষ কালটা করুণ হয়ে এল স্বর। বলল, ঈশ্বরী, এই ক্রিমটা ট্রাই করবে? ইমপোর্টেড। ঈশ্বরী, গম্ভীর, বসে ছিল। আচমকা খসখসে গলায় বলতে শুরু করল, বেশ কাটল তিনটে দিন, অ্যাঁ? ফিরে গিয়ে আবার সেই কাজের প্রেশার, লোকজন খুশি করার চক্কর। ওকে পেছন থেকে তখন জড়িয়ে ধরছে বাসন্তী, কাম অন! আজ আমরা নিজেরাই সেলিব্রেট করব এই সন্ধেটুকু। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি বেঙ্গালুরুতে, ছেলেমেয়ে ওদের কাছে। বর হায়দরাবাদে, আমি পুণেতে পোস্টেড। পিংপং বলের মতো আমাকে নিয়ে লোফালুফি চলছে পরিবারে, আর শোনানো হয়, আমার কেরিয়ারের জন্যই নাকি ফ্যামিলির লক্ষ্মীশ্রী ঘুচে গেছে।
এমন সময় হুহু হাওয়া উঠল। খুব শব্দ করে বৃষ্টি নামল। তীব্র বিদ্যুতের আলো সিলিং থেকে ঝোলানো বাহারি ঝাড়বাতিটাকে চমকে দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ছিল বার বার। গীতা মাহাতো তার এই তিন দিনের গাম্ভীর্যের ঢাকনা খুলে হেমন্তের পাতাকুড়ুনি মেয়ের মতো হি-হি করে হেসে ওঠে, দেখো গে, সুনামি এল না তো আবার! ওর দিকে মুগ্ধ চোখে চাইল নীলিমা, চলো, ব্যালকনিতে যাই। মৃত্তিকা বলল, পায়ে অসম্ভব ব্যথা করছে। অমনি সন্ধ্যা হাত বাড়াল, ধরে ধরে নিয়ে যাব তোমাকে। মৃত্তিকার কাঁধে হাত রেখে ঈশ্বরী বলল, এক বার দিল্লি চল আমার সঙ্গে। তোকে অনেক কিছু দেখাব। ওখানে আমার ছোট আর ভারী মিষ্টি একটা অ্যাকোমোডেশন আছে। নীলিমা বলল, সন্ধ্যা, একটা সিগারেট দেবে? আগে খাইনি তো কখনও। গীতা, তোমার অসুবিধা হবে না তো? গীতা দু’দিকে মাথা দোলায় বাচ্চাদের ধরনে। বলে, বাড়ির লোকগুলো এত হারামি, আমার রোজগারে খাবে, তাই যখনই বিয়ের কথা ওঠে, তখনই বাগড়া দেয়। রোহিণী মহাজনের চকচকে চোখে জল আর খুশি, একসঙ্গে। এই তো! তিন দিন যে সেমিনার আমরা ঠিকমত ওয়ার্ক-আউট করে উঠতে পারিনি, আজ এই ঘরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেটা। চোখ বুজে আসে মৃত্তিকার। সেমিনার? ওটা তো আসলে একটা বাহানা, ছুতো মাত্র! আমাদের একে অন্যের সঙ্গে মিলবার জন্য। নিজেদের ইচ্ছে স্পষ্ট ভাবে আমরা কখনও জানাতে পেরেছি, বলো তো? সব সময় একটা না একটা বাহানা দিয়ে আড়াল করতে হয়েছে সেই বাসনাকে।
নানা রঙের মেয়েতে ভরে গেল তখন, সন্ধের বারান্দা। যে যার নিজের মাতৃভাষায় সুর ভাঁজছে। মাথা আর শরীর বেয়ে নেমে আসছে প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কণ্ঠস্বর। একটাই ভুবনে।
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|