|
|
|
|
|
|
|
অশরীরী দাবাড়ু |
রাহুল মজুমদার |
সেবার পুজোর ছুটিতে ছোটমামা আসতেই বান্টি আর তার ভাই বিশাল আবদার করল, ‘ছোটমামা, ভূতের গল্প বলো।’
ছোটমামা বান্টি আর বিশালের হিরো। ভাল ছাত্র ছিলেন, এখন ভাল চাকরি করেন। তবে সেসব নয়, ছোটমামা খুব ভাল ক্রিকেট খেলেন আর তার চেয়েও ভাল বলেন গল্প। যদিও তাদের মা মাঝে মাঝেই সাবধান করে দেন এই বলে, ‘তোরা কিন্তু তোদের ছোটমামার গল্পগুলোকে বিশ্বাস করিস না। ছোট থেকেই বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলা ওর স্বভাব।’ অবশ্য বান্টি-বিশালের তাতে কিছু যায়-আসে না, তারা গল্প শুনতে পেলেই খুশি।
যে যা-ই হোক, ভাগ্নে-ভাগ্নীদের আর্জি শুনে ছোটমামা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোরা ভূতে বিশ্বাস করিস?’
বিশাল বলল, ‘এমনিতে করি না, তবে রাত্রিবেলায় যদি একা একা বাইরে বের হতে হয়, তা হলে গা-টা কেমন ছমছম করে।’
ছোটমামা জিজ্ঞাসা করলেন, তোরা দুই ভাইবোন তো রোজ দাবা খেলিস, ভূতের সঙ্গে দাবা খেলেছিস কখনও?
প্রশ্ন শুনে বান্টি আর বিশালের মুখ দিয়ে কথা বের হয় না; কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হয়ে বান্টি জিজ্ঞাসা করল, তুমি খেলেছ ছোটমামা?
ছোটমামা বললেন, আমি নয়, তবে আমার বন্ধু পুলক খেলেছে। পুলক আমার সঙ্গে চাকরি করে। আজ তোদের পুলকের গল্পই বলব।
বিশাল একটু সন্দেহের সুরে বলল, গল্পটা কি সত্যি ছোটমামা?
ছোটমামা বললেন, গল্পটা সত্যি রে বোকা, ঘটনাটা আমার জীবনে না ঘটলেও সত্যি, কারণ পুলক কখনও মিথ্যে বলে না।
গল্পটা বান্টি বিশালের ছোটমামার জবানিতেই তুলে দিলাম। |
|
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য |
পুলক থাকত বাংলার এক ছোট মফস্সল শহরে। তার বাবা ছিলেন এক জন ব্যবসায়ী। নবীন ছিল পুলকের অভিন্নহৃদয় বন্ধু। দুই বন্ধুর মধ্যে সব বিষয়ে দারুণ মিল, তারা হাসতে হাসতে একে অপরের জন্য প্রাণ দিতে পারে কিন্তু একটা বিষয়ে তারা হল পরস্পরের চরমতম প্রতিদ্বন্দ্বী আর সেটা হল দাবা খেলা। তারা দু’জনেই দাবা খেলতে ভালবাসে আর খেলেও খুব ভাল। এই খেলায় তারা কেউ অপরের কাছে হারতে রাজি নয়। শুধু তাই নয়, এই খেলাকে উপলক্ষ করে তাদের দু’জনের মধ্যে কয়েক বার ঝগড়াঝাঁটি হয়ে কথা বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু পরস্পরের প্রতি নিখাদ ভালবাসার জন্য বন্ধুত্ব আবার জোড়া লাগতে দেরি হয়নি।
সে বছর শহরের ‘যুবশক্তি’ ক্লাব কিশোরদের জন্য একটি দাবা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। খবরটা নিয়ে এল নবীন। পুলককে বলল, শোন পুলক, ‘যুবশক্তি’ ক্লাব একটা দাবা টুর্নামেন্ট করবে বলে ঠিক করেছে। তুই আর আমি দু’জনেই নাম দেব, কারণ তোকে হারিয়ে কাপ জেতার মতো সুখ আর কিছুতে নেই।
পুলক বলল, তোকে আমি চ্যালেঞ্জ করলাম নবীন, কাপ আমিই জিতব।
শুনে নবীন রসিকতা করে বলল, আমি যদি টুর্নামেন্টে হেরে গিয়ে মরেও যাই, তা হলেও আমি ভূত হয়ে এসে তোর হাত থেকে কাপ ছিনিয়ে নেবই।
এই কথার পর দুই বন্ধু প্রাণ খুলে খানিকক্ষণ হাসল। নির্দিষ্ট দিনে ওরা দু’জন গিয়ে নাম দিয়ে এল প্রতিযোগিতায়।
সময় মতো দাবা প্রতিযোগিতা আরম্ভ হল। পুলক আর নবীন দু’জনেই এগিয়ে চলল অপ্রতিহত গতিতে এবং প্রত্যাশা মতোই ফাইনালে পরস্পরের মুখোমুখি হল। এই খেলায় তারা দু’জনেই নিজেদের যাবতীয় দক্ষতা আর ক্ষমতাকে উজাড় করে দিল। এই খেলায় শেষ পর্যন্ত পুলক হারিয়ে দিল নবীনকে আর কাপও জিতে নিল।
এই খেলার ফলে নবীন আর পুলকের মধ্যে আর এক দফা মনোমালিন্যের সূত্রপাত হল। নবীন পুলকের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল। পুলক নিজেকেই অপরাধী ভাবতে লাগল। এবং আশা করতে লাগল যে খুব তাড়াতাড়ি এক দিন নবীনের রাগ পড়ে যাবে এবং তাদের সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হবে।
তার পর এক দিন বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটল। বাড়ি থেকে মামাবাড়ি যাওয়ার পথে এক দুর্ঘটনায় অকালে মারা গেল নবীন। খবর পাওয়া মাত্রই কর্তব্যের তাড়নায় বুকে পাথর বেঁধে নবীনের বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেল পুলক। নবীনের মা ঘনঘন জ্ঞান হারাচ্ছেন, বাবার চোখে জল। কাঁদতে কাঁদতে বললেন মামার সঙ্গে ট্রেনে করে মামাবাড়ি দুর্গাপুর যাচ্ছিল নবীন; হঠাৎ আর একটা ট্রেনের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা। বহু লোক মারা যায়, তার মধ্যে ছিল নবীন আর তার মামা।
মনের কষ্ট মনে চেপে বাড়ি ফিরল পুলক। তাদের বাড়িতেও শোকের আবহাওয়া। নবীন এ বাড়িতে সকলের কাছেই খুব প্রিয় ছিল। তার এই অকালমৃত্যু পুলকের বাবা মা-ও মেনে নিতে পারেননি। এই কষ্টের মধ্যে কেটে গেল কয়েকটা দিন।
পুলকের বাড়িতে নবীনের জন্য শোক অনেকটা হাল্কা হয়ে এসেছে। সে-দিন সন্ধ্যাবেলা তখন লোডশেডিং ছিল। পুলকের বাবা-মা কাছাকাছি এক বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেছেন। পরীক্ষা সামনে বলে পুলক বাড়িতে বসে পড়াশোনা করছিল। বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল অঝোরে। এমন সময় পুলক শুনতে পেল সদর দরজায় কে যেন ঠক ঠক করছে। ঠক ঠক করার ধরনটা পুলকের খুব চেনা। শব্দটা করা হচ্ছে দরজার উপর খুচরো পয়সা দিয়ে টোকা মেরে, যেমনটা করত, হ্যাঁ, নবীন। পুলক স্বাভাবিক কারণেই খুব ঘাবড়ে গেল, কিন্তু কোনও এক অজানা শক্তি তাকে দরজা খুলতে বাধ্য করল। বাইরে নিঝুম অন্ধকার, কাছাকাছি কেউ নেই। দরজা বন্ধ করে ঘরে ফিরে এল পুলক। কিছুক্ষণ পর আবার দরজায় আওয়াজ, সেই একই ধরনের। কিন্তু আশ্চর্য, এ বার আর ভয় পেল না পুলক। দরজাটা খুলে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার পর জোর গলায় জিজ্ঞাসা করল, কে নবীন? আমাকে কি কিছু বলবি? কিছুক্ষণ নীরবতা। তার পর বাতাসে শোনা গেল নবীনের কণ্ঠস্বর, শোন পুলক, আমার আর তোর মধ্যেকার দাবা কম্পিটিশনের ফাইনালের ফলাফলকে আমি মানি না। আমার ইচ্ছা আমাদের মধ্যে সেই ফাইনাল ম্যাচ আবার হবে, জিতবে যে, কাপ পাবে সে। ভয়ে ভয়ে পুলক জিজ্ঞাসা করল, খেলাটা কী ভাবে, কখন আর কোথায় হবে? অশরীরী কণ্ঠস্বর বলল, আগামী আট তারিখ আমার জন্মদিন। ওই দিন বিকেলবেলা তুই আমাদের বাড়িতে আমার ঘরে যাবি। সেখানেই ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় আমাদের ফাইনাল খেলা হবে।
সে দিনের সেই ভৌতিক অভিজ্ঞাতার কথা গোপন রাখল পুলক। শুধু অপেক্ষা করতে লাগল কবে আট তারিখ আসবে। সাত তারিখ সন্ধ্যাবেলা নবীনের বাড়ি গেল পুলক। নবীনের বাবাকে বলল, ‘কাকু, আমার ইচ্ছা নবীনের এ বারকার জন্মদিনে আমি ওর সঙ্গে কিছু সময় কাটাব। তাই আপনি যদি অনুমতি দেন তা হলে আমি আগামী কাল বিকেল থেকে সন্ধে পর্যন্ত ওর ঘরে থাকব।’ নবীনের বাবা আপত্তি করলেন না। নবীনের অকালমৃত্যুর পর থেকে তার ঘরটা সব সময় তালা বন্ধ থাকত। সেই ঘরের কোনও জিনিসেই তার পর থেকে কেউ হাত দেয়নি। সবই ছিল আগের মতো।
পরের দিন বিকেলবেলা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নবীনের বাড়ি গেল পুলক। ব্যাগের মধ্যে নিল একটা দাবার বোর্ড আর কাপটা।
নবীনের বাড়ি পৌঁছে তার বাবার থেকে তার ঘরের চাবিটা চেয়ে নিল পুলক। তার পর নবীনের ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল। ক্রমে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল। এমন সময় হঠাৎ লোডশেডিং। নবীনের ঘরের পুরনো দেওয়াল ঘড়িটায় ঢং ঢং করে সন্ধ্যা সাতটা বাজার আওয়াজ পাওয়া গেল।
ঘরের ভেতর একটা বড় টেবিল ছিল। তার উপর নবীনের একটা ছবি ছিল। সেই ছবিটার সামনে পুলক দাবার বোর্ড পেতে একটা মোমবাতি ধরাল। তার পর প্রথম চাল দিয়ে খেলা শুরু করল। উল্টো দিক থেকেও এক অশরীরী দাবাড়ু একটা চাল দিল। পুলক একদম ভয় পেল না, কারণ এমন যে হবে সে তো জানত। খেলা চলতে থাকল; দুই প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ কারও থেকে কম যায় না। তার পর এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ইচ্ছাকৃত ভাবে একটা ভুল চাল দিল পুলক, কারণ সে জানত কাপ না নিয়ে নবীনের আত্মা তাকে মুক্তি দেবে না।
শেষ পর্যন্ত নবীনই জিতল। ঘর থেকে বের হয়ে আসবার আগে নবীনের ছবির সামনে কাপটা রেখে পুলক বলল, নবীন তোর জন্মদিনে এটাই আমার উপহার।
বিশাল, বান্টি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল। হঠাৎ মা এসে তাদের বললেন, তোকে কত দিন না বলেছি বিজু, ও সব ছাইপাঁশ গল্প বলে বাচ্চাগুলোকে ভয় দেখাবি না।
বান্টির ছোটমামা বললেন, পুলক এখনও আমার সঙ্গে চাকরি করে দিদি। ইচ্ছা করলে ওর সঙ্গে দেখা করে তুমি আমার গল্পের সত্যতা যাচাই করে নিতে পার। |
|
|
|
|
|