|
|
|
|
জলাধার পরিষ্কার করতে মনমোহনের দ্বারস্থ মমতা |
অনিন্দ্য জানা • কলকাতা |
চলতি বর্ষার মরসুম শেষ হওয়ার পরেই ‘জরুরি ভিত্তিতে’ পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খণ্ড সীমানা সংলগ্ন চারটি জলাধার এবং ঝাড়খণ্ডের একটি জলাধার ‘আধুনিকীকরণে’র আর্জি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে চিঠি লিখছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একই সঙ্গে তিনি চিঠি দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী পবন বনশলকেও। পাশাপাশি, মঙ্গলবার থেকেই যাতে তৃণমূলের সাংসদরা বিষয়টি নিয়ে সংসদের দুই কক্ষে সরব হন, সেই নির্দেশও দিয়েছেন মমতা।
শনিবার মহাকরণ সূত্রে জানা গিয়েছে, মুখ্যসচিব সমর ঘোষকে ওই চিঠির খসড়া তৈরির কথা ইতিমধ্যেই বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এ দিন তিনি ওই বিষয়ে মুখ্যসচিব ও অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের সঙ্গে জরুরি বৈঠকও করেন।
প্রশাসনিক সূত্রের কথায়, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য খুব স্পষ্ট প্রতি বছর বর্ষায় ওই পাঁচটি জলাধার থেকে বিপুল পরিমাণ জল ছাড়ার ফলে পশ্চিমবঙ্গ ‘বিপন্ন’ হচ্ছে। এই পরিমাণ প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বছর ষাটেক আগে জলাধারগুলি নির্মাণের পর থেকে সেগুলির ‘আধুনিকীকরণ’ হয়নি। যার ফলে বছর বছর দুর্ভোগ বাড়ছে এ রাজ্যের। মুখ্যমন্ত্রী চান, শুখা মরসুমে যখন জলাধারে জলের পরিমাণ কম থাকবে, তখন যেন সেগুলির ‘আধুনিকীকরণের’ কাজে হাত দেওয়া হয়। রাজ্য প্রশাসনের এক পদস্থ অফিসারের কথায়, “যে ভাবে প্রতি বছর জলাধারগুলি থেকে জল ছাড়ার পরিমাণ বাড়ছে, তাতে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলার নতুন নতুন এলাকা বিপন্ন হয়ে পড়ছে। কেন্দ্রীয় সরকারকে এ বিষয়ে নজর দিতেই হবে। প্রধানমন্ত্রী এবং বিভাগীয় মন্ত্রীকে চিঠি লিখে মুখ্যমন্ত্রী সেই আবেদনই করতে চান।”
জলাধার-বিশেষজ্ঞরা অবশ্য মনে করছেন, খাতায় কলমে জলাধারগুলির জলধারণ ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব হলেও বাস্তবে তা করে ওঠা যাবে না।
|
|
বস্তুত, রাজ্যের বন্যা-পরিস্থিতি নিয়েই আপাতত সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী। শনিবার সরকারি ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও বন্যার খবরাখবর নিতে মমতা সন্ধের পরেও মহাকরণে ছিলেন। একাধিক বার তিনি কথা বলেন মুখ্যসচিবের সঙ্গে। তিনি নিজে শুক্রবার হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরে বন্যা পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে গিয়েছিলেন। এ দিন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠিয়েছিলেন তাঁর মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য ও দলীয় বিধায়ককে। যাঁদের কাছ থেকে এসএমএস এবং সেলফোনে দিনভর এলাকার পরিস্থিতির খোঁজ নেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রসঙ্গত, সরকারি ত্রাণ দ্রুত পৌঁছনোর নির্দেশ দেওয়া ছাড়াও শুক্রবার উদয়নারায়ণপুরে গিয়ে বন্যাদুর্গতদের জন্য দলীয় মুখপত্রের তহবিল থেকে নিজে অর্থ বরাদ্দ করে এসেছেন মমতা। এ দিনও জরুরি ভিত্তিতে পাঠানো হয়েছে সরকারি ত্রাণ। তা ছাড়াও, দলের মন্ত্রী-বিধায়করা দলের তরফে বা নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে ত্রাণ নিয়ে গিয়েছেন। মহাকরণে এ দিনও সরকারের মোট ২৩টি দফতরকে নিয়ে বন্যা-পরিস্থিতি মোকাবিলায় মুখ্যসচিবকে বৈঠক করার নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
সন্ধ্যায় তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত নেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গিয়েছে।
কিন্তু মমতার আবেদন মেনে এই জলাধারগুলির ‘আধুনিকীকরণ’ কি সম্ভব?
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলাধারের ‘আধুনিকীকরণ’ সম্ভব নয়। একমাত্র ‘খাতায় কলমে’ জলাধারের গভীরতা বা নাব্যতা বাড়িয়ে তাদের জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবিক ভিত্তিতে আবার তা-ও সম্ভব নয়।
সম্ভব কী করে?
জলাধারের নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য জলের নীচে ক্রমশ জমতে-থাকা পলি (যা মাটি ধুয়ে ধুয়ে এসে জলাধারের মুখে জমা হয়) সাফ করে এবং যেখান থেকে জল আসছে, সেখানে (পরিভাষায় ‘আপার-স্ট্রিম’) বনসৃজন তথা ভূমি সংরক্ষণ করে এবং সেই এলাকার কাছাকাছি ছোট ছোট বাঁধ (পরিভাষায় ‘চেক-ড্যাম’) তৈরি করে পলি যথাসম্ভব আটকানোর চেষ্টা করে।
কেন তা বাস্তবে অসম্ভব?
প্রথমত, জলাধারের কংক্রিটের কাঠামো বদলানো যায় না। ফলে জলাধারের উচ্চতা বৃদ্ধি সম্ভব নয়। জলাধারের গভীরতা কমতে থাকে ক্রমাগত পলি পড়তে পড়তে। সেই পলি কী ভাবে সাফ করা যায়, সে সম্পর্কে কারওরই কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। জলাধারের সমস্ত জল বার করে জায়গাটা ফাঁকা করে দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে সামগ্রিক ভাবে ড্রেজার নামিয়ে সমস্ত পলি তুলে ফেলা যাবে না। বড়জোর শুখা মরসুমে বা গরমের সময় জলাধারের ধার দিয়ে পলি সাফ করার কাজ করা যেতে পারে। কিন্তু জলাধারের মাঝামাঝি পৌঁছে কখনও পলি তোলা যাবে না। আর পলি কতটা জমেছে, তা মাপারও কোনও ‘নির্ভরযোগ্য’ উপায় নেই। যে উপায় রয়েছে, তা-ও প্রয়োগ করা হয় না। সেটা মূলত প্রশাসনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো ‘গয়ংগচ্ছতা’র জন্যই। ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগে ভূমি সংরক্ষণের একটি দফতর রয়েছে বটে। কিন্তু সরকারের অন্যান্য দফতরের মতোই সেখানেও কাজের কাজ বিশেষ কিছু হয় না।
দ্বিতীয়ত, ডিভিসি-র যে চারটি জলাধার (মাইথন, পাঞ্চেৎ, তিলাইয়া এবং কোনার) ঝাড়খন্ড-পশ্চিমবঙ্গ সীমানার কাছাকাছি অঞ্চলে রয়েছে, সেগুলি থেকে রাজ্যে সারা বছর শিল্পের জন্য জল সরবরাহ করা হয়। ফলে নির্দিষ্ট একটা পরিমাণ জল ধরে রেখে তার থেকে অল্প অল্প পরিমাণ জল সারা বছর ধরেই ছাড়তে হয়। তা ছাড়াও রয়েছে শুখা মরসুমে সেচের জল। সে কারণেই কোনও জলাধারই একেবারে ফাঁকা করে দিয়ে পলি সাফ করা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে শিল্পের জন্য যেমন জল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে, তেমনই আসানসোল-দুর্গাপুর এলাকার মানুষও বিপন্ন হয়ে পড়বেন।
তৃতীয়ত, পলি কোনওক্রমে তোলা হলেও সে পলি কোথায় ফেলা হবে, সে সম্পর্কেও কোনও স্পষ্ট ধারণা কারও নেই। একটা সময়ে ভাবা হয়েছিল, কয়লাখনি অঞ্চলে কয়লা তোলার পর মাটির নীচের ফাঁকা অংশে পলি ভরে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেই চিন্তাভাবনাও শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।
চতুর্থত, এই চারটি জলাধার এবং ঝাড়খণ্ডের তেনুঘাট (যা আপাতত মমতাকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে) তৈরি হয়েছিল বন্যা আটকাতেই।
তখন ধরে নেওয়া হয়েছিল, মোটামুটি ভাবে ১০ লক্ষ কিউসেক হারে জল আসবে। সে ক্ষেত্রে ঠিক হয়েছিল, সারা বছরের বিভিন্ন ‘ব্যবহারের’ জন্য মোট সাড়ে সাত লক্ষ
কিউসেক হারে জল ধরে রেখে বাকি আড়াই লক্ষ কিউসেক জল ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু কয়েক দিন ধরে অতিবৃষ্টি চলতে থাকলে আবার
জলের পরিমাণ অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পাবে। যা এ বছর হচ্ছে। এবং এর সঙ্গেই যোগ করতে হবে গত প্রায় ৬০ বছরে পলি জমতে জমতে জলাধারের নাব্যতা কমে যাওয়াও। ফলে
জলাধার বাঁচাতে হিসেবের বাইরে জল ছাড়তেই হচ্ছে!
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এত সব ব্যাখ্যায় যেতে চাননি। অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে রাজ্য বিপন্ন হবে। ঘনিষ্ঠ
মহলে মমতা অভিযোগ করেছেন, বিগত রাজ্য সরকারের উদ্যোগ-হীনতার জন্যই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে প্রশাসনিক
সূত্রের ব্যাখ্যা, যে হেতু এই জলাধারগুলির অধিকাংশই অন্য রাজ্যের সঙ্গে ভাগাভাগিতে তৈরি, তাই একটি রাজ্য সরকারের পক্ষে কিছু করা সম্ভবও নয়। তা ছাড়া জলাধারগুলি কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থা ডিভিসির। যা শুনে মমতা-ঘনিষ্ঠ এক সাংসদ বলছেন, “সিপিএমের সরকার তো এত দিন চুপচাপই বসেছিল! ৩৪ বছরে তারা কোনও ভাবেই উদ্যোগী হয়নি! তারাও তো বিহার বা ঝাড়খণ্ড সরকারের সঙ্গে কথা বলে কেন্দ্রের কাছে আর্জি জানানোর সদিচ্ছা দেখাতে পারত!” ওই সাংসদের বক্তব্য, “মমতা’দি বিষয়টা নিয়ে ভেবেছেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে হস্তক্ষেপের আর্জি জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমাদেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সংসদে বিষয়টি নিয়ে সরব হতে। দেখা যাক না, শেষ পর্যন্ত কী হয়। আমাদের নেত্রী তো লড়াই করে রাজ্যের জন্য অনেক কিছুই নিয়ে আসতে পেরেছেন। যে পলি সাফ করার কাজটা সরকারি গাফিলতিতে অসম্ভব মনে হচ্ছে, সেটাই হয়ত তখন সম্ভব হবে!” |
|
|
|
|
|