|
|
|
|
|
|
|
সমুদ্র ও অমিতাভ |
রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায় |
একদম ঘাবড়িয়ো না! মাথা ঠান্ডা রাখো! তোমার সামনে এখন গোটা লাইফ পড়ে রয়েছে... শুনতে পাচ্ছ?
হুঁ।
এই নম্বরটা কি তোমার মোবাইলের?
হুঁ।
খালি হুঁ হুঁ করবে না। ওতে কনফিডেন্স কমে যায়। পরিষ্কার হ্যাঁ বা না বলে উত্তর দাও।
হ্যাঁ আমার।
বাঃ, এই তো! তুমি তো দেখছি বেশ স্মার্ট ছেলে। আচ্ছা, প্ল্যাটফর্মের ডেনজার লাইন, মানে সাদা দাগটা থেকে তুমি নিশ্চয়ই এখন অনেক ভেতরে...
হুঁ।
আবার হুঁ?
হ্যাঁ, ভেতরে, ভেতরে।
দ্যাটস গুড। এ বার তুমি মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাইরের কম্পাউন্ডে ফাস্ট ফুডের যে নতুন বড় দোকানটা হয়েছে, ওটার সামনে দাঁড়াও। আমি চট করে চলে আসছি।
এর কি কোনও দরকার আছে? আমি বরং বাড়ি চলে যাই।
নিশ্চয়ই দরকার আছে। আমার সঙ্গে কথা বললে রিল্যাক্সড লাগবে তোমার। বেশিক্ষণ না, মিনিট দশেক। কেমন? তার পর বাড়ি চলে যেয়ো।
আপনি কেন ফালতু এত চাপ নিচ্ছেন? আমি কিন্তু ঠিক আছি!
আমি জানি তুমি ঠিক আছ। আমি শুধু তোমার সঙ্গে আলাপ করতে যাচ্ছি। জাস্ট আলাপ করতে। আচ্ছা, তুমি রেড গেঞ্জি আর ডেনিম জিন্স পরে আছে বললে, তাই না?
হ্যাঁ। আর আমার পিঠে একটা ল্যাপটপ ব্যাগও আছে।
ঠিক আছে। আমি এক্ষুনি পৌঁছচ্ছি, কেমন?
বাই।
ফোনটা ঝট করে রেখে অমিতাভ সেন নিজের মোবাইল থেকে টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের কনট্রোল রুমের ফোন ধরে নিল। অফিসার ইনচার্জকে নিজের পরিচয় দিয়ে লাল গেঞ্জি আর ব্লু জিন্স পরা ব্যাগ পিঠে ছেলেটাকে ও খুব তাড়াতাড়ি ট্রেস আউট করতে রিকোয়েস্ট করল। বলল, ছেলেটা যেন বুঝতে না পারে... শুধু নজর রাখতে বলবেন... আশা করি এখন আর ডেনজারাস কিছু ঘটবে না... আমি রাসবিহারীতে... মিনিট পনেরোর মধ্যে ঢুকে যাব। নাসিরুদ্দিন শাহ খুব থমথমে ভারী গলায় যে আত্মহত্যা এড়ানোর বিজ্ঞাপনটি মেট্রোর ইন-সার্কিট টিভিতে ফোন নম্বর সমেত দিয়ে থাকেন, সেই সংস্থাটিতেই ভলান্টারি সার্ভিস দেয় অমিতাভ। রোজ নয়, শুধু শনি আর রবিবার দুপুরের দিকটায়। অ্যাভারেজ বলে, ওই সময়টাই মেট্রোয় সুইসাইড করার আইডিয়াল টাইম। প্রায় চল্লিশ জন মানুষ তাঁদের টার্গেট পয়েন্ট হিসেবে ঠিক করে নিয়েছিলেন ওই সময়টাকেই। ওয়েল শেভড ফর্সা গালে হাল্কা নীলাভ ছোঁয়া মাখা ঝকঝকে ছেলেটাকে হাত কুড়ি দূর থেকে দেখে কেমন অবাক হয়ে গিয়েছিল অমিতাভ। এ-ই ওকে ফোন করেছিল? এ ছেলে মেট্রোয় ঝাঁপাবার কথা ভাবছে কেন? প্রেমের ধাক্কা! ডিচ! চাকরির ফ্রাসট্রেশন বা পারিবারিক অশান্তির ছাপ মোটেই পড়েনি ওর চোখে মুখে।
হ্যাঁ, আমার সঙ্গে ফোনে... একটু আগে...
হ্যাঁ। আপনিই...
অমিতাভ সেন। কসবায় একটা রাশভারী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ইংলিশ পড়াই। তুমি কী পড়ছ?
এম এসসি ফার্স্ট ইয়ার পড়ছি প্রেসিডেন্সিতে।
প্রেসিডেন্সি! দারুণ ব্যাপার! তা তুমি এ ভাবে মনখারাপ করে... অ্যাফেয়ার? আচ্ছা চলো, কিছু খেতে খেতে না হয় কথা বলা যাক।
আমার তেমন খিদে নেই... আপনি খান।
বাচ্চা ছেলে, অত খিদে নেই-খিদে নেই করলে চলে! চলো তো ঢুকি, বলে কাচ ঠেলে সামনের বড় কনফেকশনারিটায় ঢুকে পড়ল অমিতাভ সেন।
দু’জনে দুটো চিকেন স্যান্ডউইচ হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে বন্ধ থাকা ফোয়ারাটার পাঁচিলের পাশে দাঁড়াল। ছেলেটার নাম খুব ইন্টারেস্টিং সমুদ্র। একমাত্র ইতিহাসের সমুদ্রগুপ্ত ছাড়া অমিতাভ এ নামে আর কাউকে চেনে না। এর চোখের মণির হাল্কা নীল ভাবটাও ওর নামের সঙ্গে বেশ মানানসই। এটা বলতে গেলে এই মরা বিকেলের আলোয় এই মাত্র লক্ষ করেছিল পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির অমিতাভ সেন। তার পর বাঁ পাশের কিয়স্ক থেকে তার প্রিয় ব্র্যান্ডের কোল্ডড্রিংকস দু’গ্লাস কিনেছিল।
অমিতাভ পারত পক্ষে প্যান্টের ভেতর শার্ট গুঁজে পরে না। পায়ে সারা বছর রবারের বর্ষা-চটি। প্যান্টগুলো পাতলা কাপড়ের আর নিজের পাড়ার মোড়ের সালমান টেলার্স থেকে বত্রিশ বছর ধরে মাপ দিয়ে দিয়ে বানানো। চোখের চশমার ফ্রেমটা তেরো বছরের পুরনো। তাই যথেষ্ট চওড়া আর কালো। সে সপ্তাহে দু’বার মাত্র দাড়ি কাটে একটা বিশেষ বিদেশি রেজারে আর যার একটা ব্লেডের দাম সাড়ে সাতশো টাকা। কোনও মতেই ভিড় বাসে চড়ে না আর বাজার-দোকানে গিয়ে দাম নিয়ে খ্যাচখ্যাচ করাটা কোনও দিনই ওর ধাতে নেই। অমিতাভ একলেয়ার্স খেতে খুব ভালবাসে এবং বিশ্বাস করে, কোনও মানুষের চোখের দিকে ঠিকঠিক তাকালে তার মনের ভেতরের ছবিটা ক্লিয়ার দেখতে পাওয়া যায়। আর কোনও মানুষই ভেতর থেকে কখনও খারাপ হয় না, মাঝে মাঝে অবস্থার চাপে খারাপ হওয়ার অ্যাক্টিং করে মাত্র।
পায়েলের চেয়ে সুন্দরী মেয়ে তুমি দেখোনি, ও অসম্ভব ভাল গান গাইতে পারে এগুলো সব বুঝলাম। কিন্তু ওর ভেতরটাও যে বাইরেটার মতোই সুন্দর, এটা তুমি এই ক’হপ্তার আলাপে বুঝলে কী করে?
আমি বুঝতে পেরেছিলাম। ওর চোখ দুটোয় এমন একটা ডেপথ ছিল যে, তাকাতে গিয়ে আমার ব্যাকওয়াটারের কথা মনে পড়ে যেত।
ব্যাকওয়াটার! অমিতাভ সেন চমকায়।
ওটা কেরলে। খাঁড়ি দিয়ে দিয়ে নৌকো করে ঘোরা। অনেকটা ভেনিসের মতো। হাঁসের দঙ্গল, জলের ধারে বাড়ির রোয়াকে কেউ হয়তো চুল আঁচড়াচ্ছে...
তুমি কি ভেনিসে গিয়েছিলে?
না। কেরলে গিয়েছিলাম। ডিসেম্বরে।
তা হলে ভেনিসের কথা জানলে কী করে?
বাবা বলেছে।
বাবাকে পায়েলের কথা বলেছ?
নাঃ।
কেন বলোনি?
কী বলতাম?
হু হু করে লোক বেরচ্ছে মেট্রোর গেট থেকে। দমদম থেকে এক গাড়ি ব্যস্ত মানুষ এই মাত্র টালিগঞ্জে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
বলতে নিজের ফিলিংস নিজের ইমোশন! অনেক সময় দেখবে...
কিন্তু ওকে নিয়ে তো আমার কোনও ইমোশান নেই।
তা হলে এই যে এত কিছু ভাবছিলে, যদি না হয়... না মেলে... যদি বদলে যায় সব কিছু...
ও তো ভাবনাতেই! ইন ফ্যাক্ট তেমন করে কিছু বলাই হয়নি ওকে, এত টিউশন নেয়, কোচিং... একটা বেঁটেখাটো মেয়ে হাসিহাসি মুখে অমিতাভর ডান পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাকাতেই বলল, ভাল ডালের বড়ি নেবে বাবু, মশলা পাপড়, বাড়িতে বউদিকে গিয়ে দেবে...
লাগবে না, বলে মাথা নেড়ে ও অন্য দিকে তাকালেও মঙ্গোলিয়ান ধাঁচের রোগাসোগা মেয়েটি তার একঘেয়ে সিডি-ট্র্যাক না বদলে টানা বাজিয়ে চলল।
এই, একটা বড়ি আর একটা পাপড় কত?
আঠেরো টাকা। তুমি নেবে, ভাল ডালের বড়ি...
চুপ। আমাকে দুটো প্যাকেট দিয়ে ও দিকে গিয়ে বিক্রি করো! আর বিরক্ত কোরো না।
সমুদ্র রায়চৌধুরী হিপ পকেট থেকে দামি লেদারের একটা ট্যানরঙা পার্স বার করে দুটো দশ টাকার নোট বাড়িয়ে ধরল মেয়েটার দিকে।
তুমি কখনও কিছু পুষেছ, মানে কোনও পেট পাখি, কুকুর এ রকম কিছু? চুকচুক করে স্ট্র-তে টান দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল অমিতাভ।
হ্যাঁ, আমার একটা স্কুইরেল ছিল খুব পোষা। হাত থেকে বাদাম খেয়ে যেত...
ছিল বলছ কেন, এখন নেই?
নাঃ।
মানে মারা গিয়েছে?
না।
তা হলে?
মাসখানেক হল ওর কোনও পাত্তা নেই। জাস্ট এক দিন চলে গিয়েছে।
এ মা! কোথায় গেল?
কে জানে! জানলে তো মিটেই যেত।
পায়েলের মতো?
কার মতো? পায়েল? না না, ও ঠিক চলে যাওয়ার মেয়ে নয়।
তবে কীসের মতো মেয়ে?
এ বার নিজের কোল্ড ড্রিঙ্কস-এর ঢাকনা দেওয়া সফ্ট গ্লাসটা দু’হাতের মধ্যে ধরে একটু যেন আনমনা হয়ে গেল সমুদ্র রায়চৌধুরী। সামনের ফোয়ারাটা এখন লাল-সবুজ আলোর খেলার সঙ্গে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। ও কেটে কেটে বলল, আসলে ওর জন্যে অন্য কেউ হয়তো অনেক দূরে চলে যেতে পারে। অনেক অনেক দূরে। ও হয়তো ফিলও করতে পারবে না।
হুম। কথাগুলো খোলাখুলি পায়েলের সঙ্গে ডিসকাস করা যায় না? ধরো, আমি যদি করি?
কী ডিসকাস করবেন? ডিসকাস করার মতো কিছুই তো নেই!
আচ্ছা ছাড়ো। তুমি একটা কথা খুব কুললি মাথায় রাখো। যদি কখনও এ সব ব্যাপার নিয়ে পাজল্ড লাগে, কারও সঙ্গে কথা বললে ভাল লাগবে বলে মনে হয়, তুমি মাঝরাত হলেও আমায় কল করবে, আমার মোবাইল চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে, বুঝলে?
থ্যাঙ্কস!
আরে এতে থ্যাঙ্কসের কী আছে?
পায়ে পায়ে হেঁটে ওরা দু’জন মেট্রো চত্বরের ঠিক বাইরের বড় রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে।
আপনি কোথায় ফিরবেন?
আমার বাড়ি নিউ আলিপুর। আর তুমি?
আমার শোভাবাজার।
শোভাবাজার শুনেই অমিতাভ সমুদ্রের চোখের দিকে হঠাৎ এক বার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল।
তুমি কীসে ফিরবে?
মেট্রোতে।
আজকের দিনটা বাসে ফিরলে হত না? সমুদ্র হাসছে। শব্দ না করে। আশ্চর্য সুন্দর দেখতে লাগছে ওকে। ওর ফর্সা কান দুটো একটু যেন লালচে ঠেকল অমিতাভর। সত্যি, নাকি নিয়ন আলোর জন্য?
নাঃ। আমি মেট্রোতেই ফিরব। তাড়াতাড়ি হবে।
অমিতাভ মাটিতে পড়ে থাকা একটা সিগারেট প্যাকেটের দুমড়ে যাওয়া শরীরের দিকে চোখ রেখে প্রায় বিড়বিড়িয়ে বলল, সাবধানে ফিরো! ও, আর একটা কথা, কাঠবেড়ালিটা ফিরে এলে প্লিজ জানিয়ো! ওই শনিবারের ঠিক তিন দিন পরে, মানে মঙ্গলবার সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে খবরের কাগজের পাতা উল্টোতেই নীচের দিকের একটা লম্বাটে খবরে চোখ আটকাল অমিতাভর। গত কাল রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনে এক জন তরুণী আত্মহত্যা করেছে। ওর হাতব্যাগের মধ্যে থেকে না, কোনও সুইসাইড নোট নয়, শ্যামল মিত্রর ‘মনে করো আমি নেই’ এই বহু পুরনো গানটির সম্পূর্ণ লিরিকস, স্পষ্ট ও গোটা গোটা অক্ষরে, ওর নিজের হাতে লিখে রাখা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। আর বছর পঁচিশেকের ওই মেয়েটির নাম নাকি পায়েল সেনগুপ্ত। গানটির নীচে ওই নামেই সে ইংরেজিতে সই করেছিল।
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|