জঙ্গলমহলে শান্তি ফেরাতে এক দিকে তিনি মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার ‘সবুজ সঙ্কেত’ দিয়েছেন। অন্য দিকে, সমাজের মূল স্রোতে ফেরাতে মাওবাদীদের ‘পুনর্বাসন ও অস্ত্রসমর্পণ প্যাকেজ’ আরও আকর্ষণীয় করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার তিনি ঘোষণা করেন, “আগের সরকারের ঘোষিত পুনর্বাসন প্যাকেজে আর্থিক পরিমাণ অনেকটাই কম ছিল। সেটা বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।” নতুন প্যাকেজে মূলত অস্ত্রসমর্পণের টাকাই বাড়ানো হয়েছে।
ক্ষমতায় এলে জঙ্গলমহল ও দার্জিলিং সমস্যার সমাধান করাই যে তাঁর অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকবে, গত বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে সে কথা জানিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। ক্ষমতায় আসার পরে মূলত তাঁর প্রচেষ্টায় পাহাড় সমস্যার সমাধানে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। জঙ্গলমহলের তিন জেলার সার্বিক উন্নয়নে এক গুচ্ছ প্রকল্পের কথাও ঘোষণা করে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু শুধু এতেই যে জঙ্গলমহল স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে না, তা বিলক্ষণ জানেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই এক দিকে শান্তি আলোচনার প্রক্রিয়া চালানোর জন্য তিনি বন্দিমুক্তি কমিটির কয়েক জন সদস্যকে দায়িত্ব দিয়েছেন। অন্য দিকে, এ দিনই মাওবাদীদের জন্য সংশোধিত পুনর্বাসন প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। গত কাল জঙ্গলমহলে যৌথ বাহিনীর উপর গুলি চালিয়েছে মাওবাদীরা। সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করে এ দিন মমতা বলেন, “জঙ্গলমহলে পুলিশ কর্মীদের উপর গুলি চালানো হয়েছে। যারা শান্তিতে বাধা দিতে চায়, তারা ছাড়া কেউ এ কাজ করে না।” এর পর আত্মসমর্পণ প্রসঙ্গ তুলে তিনি ‘মাওবাদী’ শব্দটিও ব্যবহার করেন, যা তাঁর মুখে সচরাচর শোনা যায় না। তিনি বলেন, “মাওবাদীরা অস্ত্র ছেড়ে মূল স্রোতে এলে রাজ্য সরকার তাদের সব রকম সাহায্য করবে।” এই সময় তিনি অস্ত্রধারীদের ‘কমরেড’ বলে সম্বোধনও করেন। বলেন, “ওঁদের কমরেডই বলব। তাঁদের বলছি খুনোখুনি ছেড়ে যাঁরা আত্মসমর্পণ করবেন, তাঁরা যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন তার জন্য সরকার সর্বতোভাবে পাশে থাকবে। এ জন্যই আর্থিক প্যাকেজও সংশোধন করা হল।”
জঙ্গলমহলে যৌথবাহিনীর অভিযানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গত বছরের ১৭ জুন আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের জন্য পুনর্বাসন প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। ঠিক ১৪ মাস পরে সেই প্যাকেজ সংশোধন করে তাকে আরও আকর্ষণীয় করল নতুন সরকার। অস্ত্র ছেড়ে আত্মসমর্পণ করলে আগের মতো এখনও টানা ৩৬ মাস ২০০০ টাকা করে ‘স্টাইপেন্ড’ মিলবে। এই সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণকারীরা সরকারি বা বেসরকারি চাকরি পেলে স্টাইপেন্ড বন্ধ করে দেওয়া হবে। এরই সঙ্গে তাদের নামে ব্যাঙ্কে জমা থাকবে দেড় লক্ষ টাকা। তিন বছর পর সেই টাকা তুলতে পারবে আত্মসমর্পণকারীরা। এটাও
নতুন ঘোষণা নয়।
মূল সংশোধন করা হয়েছে অস্ত্রসমর্পণের আর্থিক প্যাকেজে। বস্তুত, সংশোধিত প্যাকেজে অস্ত্রসমর্পণের আর্থিক পরিমাণ আগের চেয়ে অনেকটাই বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন, আগে একে-৪৭, ৫৬, ৭৪ রাইফেল জমা দিলে দেওয়া হত ১৫ হাজার টাকা। এখন তা এক লাফে অনেকটা বাড়িয়ে করা হল ১ লক্ষ টাকা। একই ভাবে এলএমজি, স্নাইপারের জন্য অর্থের পরিমাণ ২৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ২ লক্ষ টাকা। পিস্তল, রিভলভারের ক্ষেত্রে ছিল আগেকার প্রস্তাব ছিল ৩ হাজার টাকা। নতুন প্যাকেজে তা করা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। অস্ত্র ও বিস্ফোরকের তালিকায় কিছু নতুন সংযোজনও করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “আমাদের এত আর্থিক সমস্যা, ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ অবস্থা। তাতেও ভাল প্যাকেজ দিচ্ছি। সরকারি কর্মীদের বেতন দেওয়ার দায় যেমন আমাদের রয়েছে, শান্তি রক্ষার দায়ও রয়েছে। তাই মাওবাদীদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য আর্থিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।”
সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করে আগের সরকার অবশ্য বিশেষ সাড়া পায়নি। মহাকরণ সূত্রে খবর, গত জুন মাস থেকে এ পর্যন্ত মোট ৭ জন আত্মসমর্পণ করেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের শোভা মান্ডি এবং বিদ্যুৎ মাহাতো। এ ছাড়া বাঁকুড়ার রুম্পা মাহাতো, মালিনী হাঁসদা, সুজয় ওরফে বাবুরাম মুর্মু ও ধীরেন সোরেন এবং ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলার শোভন কারক। এঁরা প্রত্যেকে এখনও পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন। তবে সকলে এখনও পুনর্বাসনের সুযোগ পেতে শুরু করেননি। এই অবস্থায় আর্থিক
প্যাকেজ সংশোধন করলেও মাওবাদীরা কতটা সাড়া দেবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে প্রশাসনের মধ্যেই।
প্যাকেজ ঘোষণার পাশাপাশি মাওবাদীদের অস্ত্র ছেড়ে মূল স্রোতে ফিরে আসার জন্য এ দিন ফের আবেদন জানান মমতা। জঙ্গলমহলে ১০ হাজার আদিবাসী ছেলেমেয়েকে পুলিশে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা ফের মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “ফাইল তৈরি হয়ে গিয়েছে। মুখ্যসচিব সরকারি নির্দেশনামা তৈরি করে ফেলেছেন। আদিবাসীরা যাতে আরও বেশি সুযোগ পান, সে জন্য চাকরি পাওয়ার বয়সের ক্ষেত্রেও ছাড় দেওয়া হচ্ছে।”
মাওবাদীদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বান, “কমরেড, কেউ আমাদের শত্রু নন। আর খুনোখুনি নয়। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুন।” জঙ্গলমহলে হাসপাতাল, স্কুল কলেজ সব বন্ধ। চিকিৎসকরা কাজে যেতে পারছেন না বলে জানিয়ে মাওবাদীদের প্রতি তাঁর বার্তা, “বন্দুকের রাজনীতি ছেড়ে সুস্থ জীবনে ফিরে আসুন। আপনারাও উন্নয়নে সামিল হন। দেশের জন্য কাজ করুন। নিজের পায়ে দাঁড়ান। সরকার পাশে আছে।” পাশাপাশি অবশ্য কড়া প্রশাসকের মতোও তিনি বলেন, “কোনও অবস্থাতেই লুঠের রাজত্ব চলতে দেওয়া হবে না। কথা শুনলে ভাল। যদিও অনেক প্রলোভন রয়েছে। তবুও বলছি ভাল কাজে, উন্নয়নে, শান্তিতে, প্রগতির কাজে আপনারা সামিল হন।” |