‘আসল কারণ’ থেকে মুখ ফিরিয়েই
ভোট ভাগেই আসত জয়, মত সিপিএমের
রাজ্যে বিরোধী ভোটের ভাগাভাগিই যে এত দিন তাদের নির্বাচনী সাফল্যের আসল কারণ ছিল, এ বার আনুষ্ঠানিক ভাবে তা মেনে নিল বঙ্গ সিপিএম!
তাদের মতে, এ রাজ্যে বিরোধী ভোট বিভাজনের উপরেই বামফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আসছিল। এ বার কংগ্রেস-তৃণমূল জোট তুলনায় ‘মসৃণ’ ভাবে হওয়ায় সেই কৌশল আর খাটেনি। নিজেদের ভোটপ্রাপ্তির হার কেন কমে আসছে, তার কারণ এত দিন গভীর ভাবে অনুসন্ধান করা হয়নি বলেও স্বীকার করছে তারা।
সিপিএমের রাজ্য কমিটি সর্বশেষ পার্টি চিঠিতে স্বীকার করেছে, ‘১৯৭৭ সাল থেকে সাত বার বিধানসভা
নির্বাচনে কোনও সময়ে জেতা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের প্রত্যেকটিতে ৫০%-এর বেশি ভোট বামফ্রন্ট
পায়নি। বামফ্রন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন বরাবরই বিরোধী ভোট বিভাজনের উপরে নির্ভরশীল ছিল’। নিজেদের অতীত নির্বাচনী সাফল্য সম্পর্কে এই বিশ্লেষণ থেকেই পরিষ্কার, কেন পরমাণু চুক্তিকে কেন্দ্র করে ইউপিএ-১ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়ে বঙ্গ সিপিএমের বিরাগভাজন হয়েছিলেন প্রকাশ কারাট। ২০০৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে বামেদের ওই সমর্থন প্রত্যাহারই সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের জোট গড়ার রাস্তা খুলে দেয়।
আলিমুদ্দিনের মতে, এই জোটের জেরেই ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয় বামেদের। ২০১০-এর পুরভোটে আনুষ্ঠানিক জোট না-হলেও পুরসভা বা পঞ্চায়েতের মতো ভোটে স্থানীয় স্তরে জোট হয়েই যায়। ফলে ওই ভোটেও ভরাডুবি হয় বামেদের। এবং কংগ্রেস-তৃণমূল জোটেরই চূড়ান্ত পরিণতি এ বারের বিধানসভা ভোটে ‘বিরোধীদের’ দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ এবং বাম দুর্গের ধুলিসাৎ হওয়া।
কিন্তু সিপিএমেরই একাংশ বলছে, নির্বাচনী বিপর্যয়ের ‘আসল কারণ’ এটা নয়। দলের অনেক নেতাই একান্ত আলোচনায় স্বীকার করছেন যে, দীর্ঘ ৩৪ বছরে যে ভাবে প্রশাসনে ‘দলতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, উচ্চশিক্ষা, এমনকী প্রেসিডেন্সির মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানকেও আলিমুদ্দিনের কুক্ষিগত করে ফেলা হয়েছিল, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে চূড়ান্ত উদাসীনতা দেখানো হয়েছিল, দমদম বিমানবন্দরের আধুনিকীকরণের কাজ বেসরকারি হাতে তুলে দিতে বাধা দেওয়া হয়েছিল তারই যোগফল দলের এই পতন। বৃহত্তর নীতির ক্ষেত্রে এই ‘বিচ্যুতির’ সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সাধারণ মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, তাদের জীবনযাত্রায় অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ এবং তোলা আদায়ের মতো ঘটনা। এই সব টনাই দলকে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। কিন্তু গত মাসের শেষে খোদ প্রকাশ কারাটের উপস্থিতিতে রাজ্য কমিটির বৈঠকে এই ‘সত্য’ স্বীকার করা হয়নি। তখন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের উপরে দায় চাপিয়েই হাত ধুয়ে ফেলেছিলেন নেতারা। এ বার পার্টি চিঠিতেও সেই একই ‘দায় এড়ানোর’ পুনরাবৃত্তি।
সিপিএমের ওই নেতাদের বক্তব্য, ১৯৭৭-এর পর ১৯৯৮ সালে তৃণমূল গঠনের আগে পর্যন্ত রাজ্যে চারটি বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে। ১৯৮২, ১৯৮৭, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে। ওই চারটি নির্বাচনে বিরোধী ভোট তেমন ভাবে ভাঙার প্রশ্ন ছিল না। তা হলে বিরোধী ভোট ভাগই বামফ্রন্টের জয়ের মূলে, এই যুক্তি খাটে কী করে!
আলিমুদ্দিন সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, ওই সময়েও বামফ্রন্টের বাইরের দলগুলির মোট ভোটের হার বামেদের চেয়ে বেশি হত। যেমন, বিজেপি তখন বেশ কিছু ভোট পেত। কিন্তু ক্রমশ বিজেপি-সহ অন্য বাম-বিরোধী দলগুলির শক্তি ক্ষয় হয়েছে। সেই ভোট ক্রমশ তৃণমূল এবং কংগ্রেসের পক্ষে সংহত হয়েছে। পার্টি চিঠিতেই বলা হয়েছে, ১৯৭৭ সালের পরে এবং এ বার ২০১১-র আগে বামফ্রন্ট সব চেয়ে কম আসন পেয়েছিল ২০০১ সালে ১৯৯টি। সিপিএমের বক্তব্য, ‘তখন তৃণমূল এনডিএ না-ছেড়েই কংগ্রেসের সঙ্গে বাংলা বাঁচাও ফ্রন্ট তৈরি করেছিল’। ২০০১-এর ‘মহাজোট’ অবশ্য মসৃণ ছিল না। কংগ্রেসের টিকিট না-পাওয়া বিধায়কেরা ঘড়ি চিহ্ন নিয়ে এনসিপি-র হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন।
সিপিএমেরই একাংশের মতে, বিরোধী ভোট বিভাজনের উপরে নিজেদের সাফল্যের নির্ভরশীলতা মেনে নিয়ে রাজ্য নেতৃত্ব এক দিকে বামেদের নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক ক্ষয় নিয়ে আন্তরিক ভাবে ভাবনাচিন্তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তেমনই কারাটকেও এর মাধ্যমে কৌশলে ‘বার্তা’ পাঠানো হয়েছে। জাতীয় রাজনীতিতে বামেদের ‘প্রাসঙ্গিকতা’র অন্যতম প্রধান ভিত্তি ছিল পশ্চিমবঙ্গ। ইউপিএ থেকে সমর্থন না-তুললে এ রাজ্যে বিরোধী জোট বাস্তবায়িত হত না এবং তার জেরে বামেদের ক্ষমতাও হারাতে হত না প্রকারান্তরে এই ‘বার্তা’ই এ কে জি ভবনকে আলিমুদ্দিন দিতে চেয়েছে বলে দলের ওই অংশের মত।
এই মতের বিরোধীরা বলছেন, দলের ব্যর্থতা সর্বস্তরেই ছিল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম বা বিরোধী ঐক্য চাপা ক্ষোভে অগ্নি সংযোগ করেছিল। কিন্তু পার্টি নেতৃত্ব সেই ‘সত্য’ নিয়ে মুখ খুলছেন না। আসলে পরাজয়ের ‘বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিত’ খুঁজতে এখনও তাঁদের অনীহা।
পার্টি চিঠিতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাম জমানার সাত বারের মধ্যে ১৯৮২, ১৯৮৭ ও ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট সামগ্রিক ভাবে রাজ্যে প্রদত্ত ভোটের ৫০%-এর বেশি পেয়েছিল। বামেদের প্রাপ্ত ভোটের হারে যে আগেই ধস নামতে শুরু করেছিল, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে চিঠিতে বলা হয়েছে: ‘২০০৪ সালের চেয়ে ২০০৬ সালে ১১টি জেলায় বামফ্রন্টের প্রাপ্ত ভোটের হার হ্রাস পেয়েছিল, একটি জেলায় ছিল প্রায় সমান-সমান। আসনসংখ্যা বাড়লেও ভোটের হার হ্রাস নিয়ে নির্বাচন-পরবর্তী সাংগঠনিক ভাবনাচিন্তা গুরুত্ব পায়নি। আসন বেশি পেলেও গরিবতর শ্রমজীবী অংশের ভোট যে বিরোধীরাও যথেষ্ট পাচ্ছে এবং আমাদের সমর্থন ক্ষয় হচ্ছে, এটাও ভাল ভাবে ধরার চেষ্টা হয়নি’।
সাম্প্রতিক অতীতে বারেবারেই মাওবাদী মোকাবিলা-সহ নানা প্রশ্নে বিধানসভার ভিতরে-বাইরে তৃণমূল এবং কংগ্রেসের মধ্যে ‘বিভাজন’ সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছিলেন সিপিএম নেতৃত্ব। নিজেদের স্বার্থেই সিপিএম জোটের মধ্যে ‘টানাপোড়েন’ সৃষ্টি করতে মদত দিচ্ছে বলে অতীতে অনেক বার অভিযোগ করেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা এবং কংগ্রেস নেতৃত্ব। সিপিএম কখনওই আনুষ্ঠানিক ভাবে তা স্বীকার করেনি। বরং তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিধানসভায় বলেছিলেন, “জোড়া কংগ্রেসকে হারিয়ে তবেই আমাদের শান্তি!” কিন্তু এখন নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর্যালোচনা করতে গিয়ে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক হারানো এবং বিরোধী ভোট ভাগাভাগির উপরে নির্ভরশীলতার পারস্পরিক যোগ স্বীকার করে নেওয়া হল। চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০০৬ সাল ও পূর্ববর্তী নির্বাচনে বর্ধমান, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এবং হুগলির কয়েকটি কেন্দ্রে বামেদের প্রাপ্ত ভোট ৫০%-এর অনেক বেশি ছিল। কিন্তু এ বার মাত্র ৯টি আসনে বামফ্রন্ট ৫০%-এর বেশি ভোট পেয়েছে।
সিপিএমের মতে, ‘অতীতে কিছু আসনে নির্বাচনী ফলাফলে আমাদের পক্ষে ভোটের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বর্তমানে অস্বাভাবিক হ্রাস গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে। কোনও কোনও স্থানীয় বিষয় হয়তো নির্বাচনী ফলাফলে এই প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছে’। মোট ভোটের ৩৫.৫১% পেয়ে রাজ্যের শিল্পাঞ্চলে ৫৬টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে বামেরা যে মাত্র ৪টি পেয়েছে, তা নিয়েও গভীর উদ্বেগ ধরা পড়েছে পার্টি চিঠিতে। রাজ্য কমিটিতে পেশ করা যে পর্যালোচনা রিপোর্টের ভিত্তিতে পার্টি চিঠি তৈরি হয়েছে, তার বিশ্লেষণে, শহর এবং সংলগ্ন মিশ্র এলাকায় ৭৬টি আসনের মধ্যে বামেরা জয়ী হয়েছে ১০টিতে, ভোটের হার ৩৯.৬৯%। গ্রামীণ এলাকার ১৪৬টি আসনে বামেদের আসন ৫১, ভোটের হারও তুলনায় বেশি ৪৩.১৯%। কিন্তু এই ফলও ‘অতীতের তুলনায় অনেক খারাপ’ বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, বিধানসভা ভোটের প্রচারে অনিল বসুর মতো নেতাদের মন্তব্য দলের প্রভূত ক্ষতি করেছে বলে উল্লেখ করে রাজ্য নেতৃত্ব ‘দায়’ ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করেছেন! পার্টি চিঠিতে বলা হয়েছে: ‘সমগ্র প্রচার-পর্বে কোনও কোনও নেতৃত্বের বক্তব্যে বিনম্রতার অভাব দেখা যায় এবং দ্বিতীয় পর্বে ভোটগ্রহণের আগের দিন রাজ্য কমিটির এক সদস্যের বক্তব্য জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে, সব জেলায় নির্বাচন কর্মীদের বিব্রত করেছে। বিশেষত, মহিলাদের মধ্যে এর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। রাজ্য নেতৃত্ব জরুরি ভিত্তিতে এ সম্পর্কে ব্যবস্থা নিলেও তাতে জনমানসে তেমন ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি’। অনিলবাবুকে তখন লিখিত ভাবে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা ছাড়া কোনও ‘ব্যবস্থা’ রাজ্য নেতৃত্ব নেননি। বরং, হুগলি জেলায় অনিলবাবুর সঙ্গে একমঞ্চে বসে সভা করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু এবং সভার শেষে অনিলবাবুর পিঠে হাত রেখে তাঁকে গাড়িতে উঠতে দেখা গিয়েছিল!
First Page Next Story


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.