রহস্যমোচনের দোরগোড়ায়
সত্যেন বসুর কল্পনার ‘ঈশ্বর কণা’
টু বি, অর নট টু বি? সে আছে, না নেই? বিজ্ঞানের দুনিয়ায় মস্ত এক ধন্দের অবসান হতে চলেছে কয়েক মাসের মধ্যে।
১৯২৪ সালে এই কলকাতায় বসে সত্যেন্দ্রনাথ বসু শুধু অঙ্ক কষে যে জাতের কণার অস্তিত্ব কল্পনা করেছিলেন, ১৯৬৪ সালে এডিনবরার বিজ্ঞানী পিটার হিগ্স সেই জাতের বিশেষ যে-কণাটি বাস্তবে রয়েছে বলে দাবি করেছিলেন, তা সত্যিই আছে কি না, তা জানা যাবে আগামী বছরের গোড়াতেই।
কোন সে কণা? নাম তার ‘গড পার্টিক্ল’। ঈশ্বর কণা। নাহ্, জেনিভা শহরের অদূরে পাতালে সুড়ঙ্গের মধ্যে বিশেষ ওই কণাটির খোঁজে নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজ করছেন পৃথিবীর কুড়িটি দেশের যে-কয়েকশো বিজ্ঞানী, তাঁরা মোটেই উদগ্রীব নন ভগবানের দর্শন পেতে।
তা হলে কণাটির ও রকম নাম কেন? আসলে ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে ঈশ্বরের গুরুত্ব যেমন, পদার্থবিজ্ঞানীর কাছে ওই কণাটির মূল্যও তেমনই। ওটি যেন সব কণার সেরা। অথবা ওটি বিনা অন্য অগুণতি কণা এলেবেলে, ফালতু। কেন তা এত মূল্যবান, কী তার মহিমা, এ সব বোঝাতে ১৯৯৩ সালে আস্ত একখানি বই লেখেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী লিওন লেডারম্যান। পাণ্ডুলিপি রচনার সময় তিনি ঠাট্টার ছলে বইখানির নাম দেন ‘দি গড-ড্যাম পার্টিক্ল’। প্রকাশক তাঁকে পরামর্শ দেন নাম বদলাতে। কী নাম দেওয়া যায়? প্রকাশকের পরামর্শ : ‘দি গড পার্টিক্ল’। বেশ জুতসই। মনে ধরে যায় লেখক-বিজ্ঞানীর। হু হু করে বিকোয় চমৎকার স্টাইলে লেখা ‘দি গড পার্টিক্ল’। পদার্থবিদ্যা উপহার পায় মুখে মুখে ফেরার যোগ্য একটি নাম। বিজ্ঞানীরা কিন্তু কণাটিকে চেনেন যোগ্যতর নামে। পিটার হিগ্স এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসুর স্মরণে ওটি ওদের কাছে ‘হিগ্স বোসন’।
তো সেই হিগ্স বোসন, যার গুরুত্ব ব্যাখ্যায় লেডারম্যান লিখেছিলেন সাড়ে চারশো পৃষ্ঠার বই, যা বাস্তবে না থাকলে বদলাতে হবে পদার্থবিদ্যার অনেক ধারণা, তা সত্যি সত্যি আছে কি? প্রশ্নটার উত্তর পেতে দু’বছর ধরে শুরু হয়েছে বিজ্ঞানের এক রাজসূয় যজ্ঞ। মাটির নীচে ১০০ মিটার গভীরে ৩০ কিলোমিটার পরিধির সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। চলেছে ফলাফল পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ। যে সব বিজ্ঞানী অংশ নিয়েছেন ওই রাজসূয় যজ্ঞে, তাঁদের ছ’দিন ব্যাপী সম্মেলন বুধবার শেষ হল ফ্রান্সের গ্রেনোবল শহরে। ওখানে ওঁদের নেতা ড. রলফ হিউয়ার বলেছেন, ‘আশা করছি বড় বড় আবিষ্কার আসবে আগামী বছর। আমার মনে হয় শেক্সপিয়রসুলভ সেই প্রশ্নটিরটু বি অর নট টু বিসমাধান হয়ে যাবে আগামী বছরের গোড়ায়।’ থাকা কিংবা না-থাকার প্রশ্নটি যে সেই ‘গড পার্টিকল’ বা হিগস বোসন সংক্রান্ত, তা বলাই বাহুল্য।
যেমন বলা বাহুল্য এই তথ্যও যে, শুধু হিগস বোসন-এর খোঁজেই ব্যস্ত নেই সুড়ঙ্গ-বিহারী বিজ্ঞানীরা। জটিল পরীক্ষায় ওঁরা খুঁজছেন আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর। ব্রহ্মাণ্ডের মাত্র ৪ শতাংশ হল পদার্থ। গ্রহ উপগ্রহ নক্ষত্র ছায়াপথ। বাকি ৯৬ শতাংশ তা হলে কী? ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং থেকে আমাদের অশোক সেন পর্যন্ত সবাই বলছেন, সব তত্ত্বের মূল তত্ত্ব নাকি ‘স্ট্রিং থিওরি’। তো সেই দাবির পক্ষে প্রমাণ কোথায়? একটা আলপিনকে পৃথিবী টানে মাটির দিকে। আর একটা চুম্বক উপর দিকে। এই টানাটানির লড়াইতে পেল্লায় পৃথিবী হেরে যায় কেন একরত্তি চুম্বকের কাছে? ‘বিগ ব্যাং’ বা মহা বিস্ফোরণে ১৩৭০ কোটি বছর আগে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির সামান্য আগে এর সব কিছু মুছে যাওয়ার কথা ছিল। তার বদলে আজকের গ্রহ নক্ষত্র ছায়াপথগুলো এল কী ভাবে? হ্যাঁ, এমন সব জবর জবর প্রশ্নের জবাব খুঁজতে সুড়ঙ্গে নেমেছেন বিজ্ঞানীরা।
তবে সবচেয়ে জবর প্রশ্নটি কিন্তু ওই সত্যেন্দ্রনাথ-পিটার কল্পিত কণাটি ঘিরে। হিগ্স বোসন আছে, না নেই? কেন কণাটি ঘিরে এত কৌতূহল? এ প্রশ্নের উত্তর সোজা। পদার্থের উপাদান ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নানা রকম কণা। এদের অধিকাংশ সামান্য হলেও ভারী। মানে, তাদের ভর আছে। অন্য কিছু কণার ভর নেই। কেন নেই? কেন অধিকাংশ কণার ভর আছে? ১৩৭০ কোটি বছর আগে ব্রহ্মাণ্ডের জন্মের অব্যবহিত পরে জন্মেছিল যে-সব কণা, তাদের কারওরই তো ভর ছিল না। তা হলে কেউ কেউ সে রকম ভরহীন থেকে গেলেও বাকিরা কেন হল ভারী?
সত্যেন্দ্রনাথের ভাবনার সূত্র ধরে এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন হিগ্স। দাবি করেছেন এমন এক কণার অস্তিত্বের, যা কিছু কিছু কণাকে জুগিয়েছে ভর। অন্য কণাদের ভর জোগানোর ক্ষমতাসম্পন্ন ওই কণাটিই হিগ্স বোসন। গড পার্টিক্ল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তা কল্পনা। বাস্তবে তা শনাক্ত করা যায়নি। মজার ব্যাপার, কল্পিত হলেও তার গুরুত্ব বিশাল। ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে পদার্থের উপাদান কণাদের চরিত্র ব্যাখ্যায় গত শতাব্দীতে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে এক তত্ত্ব। যার পোশাকি নাম ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’। ওই তত্ত্বে হিগ্স বোসন-এর অস্তিত্ব ভীষণ জরুরি। কতটা? তুলনা দিয়ে বিজ্ঞানীরা বলেন, ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ যদি একটা মানবদেহ হয় তো, হিগ্স বোসন হল তার মুণ্ডুখানি। অর্থাৎ হিগ্স বোসন বিনা ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ যেন মুণ্ডহীন ধড়।
তো খোঁজ চলেছে সেই মুণ্ডুর। কী ভাবে? সুড়ঙ্গে সেকেন্ডে প্রায় ৩০০০০০ কিলোমিটার বেগে ধাবমান প্রোটন কণার সংঘর্ষে মিলছে প্রচণ্ড পরিমাণে শক্তি। তৈরি হচ্ছে ১৩৭০ কোটি বছর আগে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পর ১ সেকেন্ডের ১০০০০০০ ভাগের এক ভাগ সময়ের পরিস্থিতি। খোঁজা হচ্ছে ওই পরিস্থিতিতে হিগ্স বোসন কণার অস্তিত্ব। খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন এই খোঁজ। এ খোঁজ মানে সংঘর্ষের ফলাফল বিশ্লেষণ। সে কাজই চলছে। লাগাতার সংঘর্ষ এবং তা বিশ্লেষণের কাজে লাগবে আরও কয়েক মাস।
তার পর ২০১২ সালের গোড়ায় মিলবে সেই ‘শেক্সপিয়রসুলভ’ মহাপ্রশ্নের উত্তর। বিজ্ঞানীরা মহাপ্রতীক্ষায়।
First Page First Page Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.