সাসপেন্ড এসডিও অফিসের দুই কর্মী
লক্ষাধিক টাকার ২৪টি ‘জাল’ বিল জমা ট্রেজারিতে
জেলা স্বাস্থ্য দফতর থেকে আদৌ মঞ্জুর হয়নি তহবিল। হয়নি ওই তহবিল যে উদ্দেশ্যে মঞ্জুর হয়েছে, সেই সব কাজও। অথচ তৈরি হয়ে গিয়েছে সেই কাজের বিল। শুধু তাই নয়, সেই বিলের টাকা মেটানোর জন্য ট্রেজারি অফিস থেকে তৈরি হয়ে গিয়েছিল সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকার চেকও।
একেবারে শেষ মুহূর্তে ধরা পড়ল এই বিরাট জালিয়াতির ঘটনা। রঘুনাথপুরের মহকুমাশাসকের কার্যালয়ে এই ‘কেলেঙ্কারির’ ঘটনায় আলোড়ন পড়েছে প্রশাসনিক মহলে। সরকারি দফতরেই জালিয়াতি চক্রের সক্রিয়তা দেখে চক্ষু চড়কগাছ প্রশাসনের কর্তাদের।
কেমন সেই জালিয়াতি? প্রথমত, জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কার্যালয়ের অ্যাকাউন্টস অফিসারের সই নকল করে তৈরি হয়েছে তহবিল মঞ্জুরের নির্দেশ। দ্বিতীয়ত, সেই ‘নকল’ তহবিলের ভিত্তিতে রক্ষণাবেক্ষণ ও সাফাইকাজের মোট ২৪টি ‘জাল’ বিল তৈরি করা হয়েছে। সবেচেয়ে বড় ব্যাপার, ওই সব বিল ও আনুষঙ্গিক কাগজপত্রে অনেক অসঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও মহকুমা প্রশাসনিক ভবনের ট্রেজারি অফিসের একাধিক কর্মী সে-সব ‘দেখেও না দেখার ভান করে’ ২৪টি চেক তৈরি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু চেকে সই করতে গিয়ে তা নজর এড়ায়নি খোদ ট্রেজারি অফিসারের। আর তার পরেই প্রকাশ্যে এল জালিয়াতির বিষয়টি। তদন্তের নির্দেশ দিল প্রশাসন। ওই জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতিমধ্যেই ট্রেজারি অফিসের দুই কর্মীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুরুলিয়ার জেলাশাসক অবনীন্দ্র সিংহ। বুধবার তিনি বলেন, “তদন্তে দেখা গিয়েছে, রঘুনাথপুর মহকুমাশাসকের কার্যালয়ের ট্রেজারি বিভাগের দুই কর্মী আনন্দকুমার ফৌজদার ও শিবশঙ্কর পাঠক বিল জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে জড়িত।” আনন্দবাবু আপার ডিভিশন ক্লার্ক এবং শিবশঙ্কর পাঠক চতুর্থ শ্রেণির কর্মী (কম্পিউটার অপারেটর)। জেলাশাসক আরও বলেন, “ট্রেজারি দফতরের এক পদস্থ অফিসারও ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে তদন্তে জানা গিয়েছে। কিন্তু ওই পদের কর্মীকে রাজ্য সরকার নিয়োগ করে। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা জানতে ডিরক্টরেট অফ ট্রেজারি অ্যাকাউন্টসকে চিঠি লেখা হয়েছে।” আনন্দবাবু কোনও মন্তব্য করতে চাননি। শিবশঙ্করবাবুর দাবি, “দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নই। আমি পরিস্থিতির শিকার।”
রঘুনাথপুর মহকুমা প্রশাসন সূত্রে জানা যাচ্ছে, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে রঘুনাথপুরের ট্রেজারিতে জমা পড়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকার বিল। রঘুনাথপুরের সহকারী মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কার্যালয় পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ, রঘুনাথপুর ১ ও ২, নিতুড়িয়া, সাঁতুড়ি, পাড়া, কাশীপুরএই ছ’টি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সাফাই এবং রঘুনাথপুর মহকুমা হাসপাতাল সাফাই ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওই বিল জমা পড়ে ট্রেজারিতে। প্রতিটি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে তিনটি করে মোট ১৮টি বিল জমা পড়েছিল। এ ছাড়া তিনটি করে মোট ৬টি বিল জমা পড়ে সহকারী মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কার্যালয় এবং মহকুমা হাসপাতালের পক্ষ থেকে। সমস্ত বিলই ছিল সাফাই ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য। প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকার বিল মেটানোর প্রক্রিয়া প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল ট্রেজারি দফতরে। তৈরি হয়ে গিয়েছিল ২৪টি চেক।
কিন্তু এ মাসের মাঝামাঝি চেকের উপরে ট্রেজারি অফিসার চূড়ান্ত সই করার সময় বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ে।
কী ভাবে? প্রথমত, ওই ৮টি কার্যালয়ে কাজের বিলগুলি ছিল এ বছর মে ও জুনএই দু’মাসের। দু’মাসে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা শুধু শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য বিল প্রস্তুত করার অর্থ দু’মাসে প্রায় ৫ হাজার শ্রমদিবস সৃষ্টি হয়েছে। যা বাস্তবে সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, টাকা তোলার দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে ওই ২৪টি বিলে একই দিনে সবুজ কালিতে সই ছিল সংশ্লিষ্ট দফতরের আধিকারিকদের। তা দেখে সন্দেহ হওয়াতেই ওই ২৪টি চেক আটকে রাখেন ট্রেজারি অফিসার। ঘটনাটি জানান মহকুমাশাসককে। পুরো বিষয়টি নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে তদন্ত শুরু করেন মহকুমাশাসক।
তদন্তেই ধরা পড়ে ‘জালিয়াতি।’ দেখা যায়, জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কার্যালয়ের অ্যাকাউন্টস অফিসারের সই নকল করে তৈরি করা হয়েছিল তহবিল মঞ্জুরের নির্দেশ। পরে ছ’টি ব্লকের স্বাস্থ্য আধিকারিকদের সই ও স্ট্যাম্প জাল করে তা দেওয়া হয়েছিল বিলের উপর। একই ভাবে জাল করা হয়েছিল রঘুনাথপুরের অতিরিক্ত মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক এবং মহকুমা হাসপাতাল সুপারের সই ও স্ট্যাম্প। অর্থাৎ, ২৪টি বিলই জাল! জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিকের কথায়, “মারাত্মক বিষয়। তহবিলই মঞ্জুর হয়নি। অথচ বিলের টাকা পেমেন্ট করার কাজ শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল।”
প্রশাসনের নজরদারিতে শেষ পর্যন্ত জাল বিলের টাকা দেওয়া আটকানো গেলেও উঠে এসেছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বিল ‘পেমেন্ট’ করা হয় পাঁচটি পর্যায়ে নজরদারির পরে। শুরু থেকেই ট্রেজারি দফতরের কর্মীরা পরীক্ষা করেন, যে তহবিলের প্রেক্ষিতে বিল দেওয়া হবে, সেই তহবিল আদৌ মঞ্জুর করা হয়েছে কি না। দেখা হয় বিলের ওপর ডিডিওদের (ডিসবার্সিং অফিসার) সই, স্ট্যাম্প ও শংসাপত্র। এই সব খুঁটিয়ে দেখলেই জালিয়াতি ধরা পড়ার কথা। তাই প্রশ্ন উঠছে, কেন শেষ পর্যায়ের আগে এই জালিয়াতি ধরা পড়ল না। ওই চক্রের সঙ্গে কতটা যোগ রয়েছে সরকারি দফতরের কর্মীদের, ঘুরেফিরে উঠছে এই প্রশ্নও।
মহকুমাশাসক (রঘুনাথপুর) আবিদ হোসেন বলেন, “তদন্তে জানা গিয়েছে একটি বড় জালিয়াতি চক্র জড়িত। যে ভাবে তহবিল মঞ্জুর থেকে বিল পেমেন্ট করা হয়, সেই পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল এই চক্র। যুক্ত রয়েছেন দফতরের কিছু কর্মীও।” আর জেলাশাসক অবনীন্দ্র সিংহের কথায়, “জালিয়াতি চক্রের শিকড় দফতরের অনেক গভীরে গিয়েছে হলেই মনে করা হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য বিশেষজ্ঞ দল পাঠাতে রাজ্য সরকারকে আবেদন করা হয়েছে।” প্রশাসন সূত্রের খবর সোমবার সেই দলটির কলকাতা থেকে আসার কথা।
First Page Purulia Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.