চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
প্রতীক হয়ে ওঠে সময়ের গোপন অন্তঃসার
শিল্পী সুনীল দাসের একটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনী হল সম্প্রতি গ্যালারি কলকাতায়। শিরোনাম ‘বিওয়েয়ার-বি-অ্যাওয়ার অব দ্য আর্ট অব সুনীল’। সতর্ক বা সচেতন করার এই আহ্বান কেন? তাঁর ছবির অজস্র নকল হচ্ছে। এ জন্য শিল্পী খুব চিন্তিত বা উৎকণ্ঠিত। এই অনুকরণের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা-এই প্রদর্শনীর অন্যতম উদ্দেশ্য। স্মারকপত্রে শিল্পী লিখেছেন: ‘এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে আমি আমার বর্তমানের ও ভবিষ্যতের শিল্পানুরাগী ও সংগ্রাহকদের মধ্যে সচেতনতা আনতে চাই। তাঁদের নজরে আনতে চাই, আমার কাজ যাঁরা ভালবাসেন, এমন অনেক নিঃসন্দিগ্ধ সংগ্রাহকদের মধ্যে সারা দেশে এবং বিশ্বে অজস্র নকল কাজ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ এই সাবধানবাণী ও নকলের আশঙ্কা নিরপেক্ষভাবেই প্রদর্শনীটি নান্দনিকভাবে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে নকল ছবির পাশে তাঁর আসল ছবি রেখে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে, অনুকৃত ছবিতে আসল ছবির বৈশিষ্ট কেমন করে লুপ্ত হয়ে যায়।
ছবির নকল হওয়াটা আধুনিক ধনতান্ত্রিক ভোগবাদী সমাজে অন্যান্য নানা দুর্নীতির মতোই একটি অপ্রতিরোধ্য উপসর্গ। প্রাক-আধুনিক লৌকিক শিল্পে কোনও নকলের ব্যাধি ছিল না, কেন না সেখানে শিল্পীর উপর বাজারের কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। বাজার লাভ বোঝে। আধুনিক সফল শিল্পীও নান্দনিকতার পাশাপাশি ‘লাভ’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন। যতই তিনি সফল হন, ততই তাঁর ছবির দাম বাড়ে। আর নন্দন নিরপেক্ষভাবেই সেই দাম আকাশ ছোঁয়। কোনও দুর্নীতিই যেমন আইন করে আজ পর্যন্ত নির্মূল করা যায়নি, তেমনই নকল ছবিতেও যাবে না। কিন্তু আবার এই কথাটাও সত্য, একজন শিল্পীর প্রকাশকে অন্য কোনও নকলনবিশ কখনও হুবহু অনুকরণ করতে পারে না। দু’জন মানুষের লেখা বা রেখার চরিত্র কখনও এক হয় না। তাই নকল ছবি চেনা খুব কঠিন নয়। সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলো কোথায় থাকে, সেটা দর্শককে বুঝতে সাহায্য করাই এই প্রদর্শনীর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।
শিল্পী: সুনীল দাস

সেটা এই প্রদর্শনীর একটি দিক মাত্র। এই প্রদর্শনী আকৃষ্ট করে আরও অনেকগুলি বৈশিষ্টের জন্য। তার একটি হল ঘোড়ার বিবর্তন। এ কথা সকলেই জানেন, সুনীল দাস ঘোড়ার ছবির জন্য বিখ্যাত। কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজে ১৯৫৯ সালে তিনি যখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, তখনই তিনি ললিত কলা অ্যাকাডেমির জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন ঘোড়ার ড্রয়িং-এর জন্য। সেই ঘোড়া তিনি এখনও নিরন্তর এঁকে যান। সেই ষাটের দশকের ঘোড়া আর আজকের ঘোড়ায় কি কোনও পার্থক্য আছে? এই প্রদর্শনী আমাদের আরও একবার বুঝতে সাহায্য করল। আসলে তাঁর ঘোড়া তো নিছকই ঘোড়ার অবয়বে শেষ হয়ে যায় না। তার ভিতর থাকে যেমন শিল্পীর চৈতন্যের তেমনই দেশ-কালের আলো-আঁধারি। ১৯৫৯-৬০-এর অনেক ঘোড়া আছে এই প্রদর্শনীতে। তাদের শীর্ণ অবয়বের মধ্যে অনুভব করা যায় রিক্ততার আভাস। এই রিক্ততার মধ্যে বিষাদবোধ সেই সময়ের কিছু সারাৎসারকে মেলে ধরে দর্শকের সামনে। ২০১০ সালেও তিনি ঘোড়া এঁকেছেন। অনেক সম্ভ্রান্ত সেই ঘোড়া। অনেক জঙ্গম, অনেক উচ্চকিত, অশান্ততায় আলোড়িত। ঠিক আজকের সময়টা যেমন। এই যে সময়ের গভীর গোপন অন্তঃসারকে মথিত করে উপযুক্ত প্রতীক গড়ে তোলা, এটাই একজন শিল্পীর প্রধান সামাজিক অবদান।
সেই ১৯৫৮-৫৯ থেকে আজ পর্যন্ত সুনীল অজস্র বিষয়, অজস্র আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। আঙ্গিক বা রূপভাবনার এ রকম ব্যাপ্তি খুব বড় শিল্পীর মধ্যেই দেখা যায়। এই প্রদর্শনীতেও তার কিছু কিছু দৃষ্টান্ত আছে। এই বৈচিত্রের মধ্যে একটি লক্ষ্যে শিল্পী স্থির থেকেছেন।
বছর দুয়েক আগে শুধু ভাস্কর্য নিয়েই একটি প্রদর্শনী হয়েছে তাঁর। এই প্রদর্শনীতে ঘোড়ার মুখের ত্রিমাত্রিক ব্রোঞ্জগুলিতে এমন এক অভিব্যক্তি পাই যা ছবির থেকে একেবারেই আলাদা। এই প্রতীকেও শিল্পী বিশ্লিষ্ট সময়ের গভীর কালিমাকেই ধরেন। ত্রিমাত্রার যে অতিরিক্ত বৈশিষ্টগুলি, তাকে প্রকৃষ্ট ব্যবহার করেন। শরীরের উপরিতলের নানা খাঁজ, অনেক অন্ধকার জমে থাকে। বর্ণের বিচ্ছুরণেও অভিব্যক্তির নানা সূক্ষ্ম আলোছায়ার খেলা চলে। ঘোড়া বা ষাঁড়-প্রাণী পরিচয়কে ছাপিয়ে হয়ে ওঠে সময়েরই প্রতীক।

Previous Item Alochona Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.